বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

বাংলাদেশি পাসপোর্টের জন্য মরিয়া রোহিঙ্গারা

আপডেট : ১৩ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ২১:৪৭

মিয়ানমার থেকে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গারা বাংলাদেশি পাসপোর্ট পেতে মরিয়া হয়ে ওঠেছে। চট্টগ্রামের দুটি পাসপোর্ট অফিসে গত কয়েকমাস ধরে আবেদনসহ একের পর এক রোহিঙ্গা ধরা পড়ছে। প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, দুটি কার্যালয়ে গত এপ্রিল থেকে আগস্ট মাস পর্যন্ত শতাধিক আবেদনকারীকে রোহিঙ্গা সন্দেহে আটক করা হয়। বাংলাদেশি পাসপোর্ট নিয়ে বিদেশে যাওয়ার সময়ও অনেক রোহিঙ্গা ধরা পড়ে। গত সপ্তাহে নগরীর আকবর শাহ এলাকা থেকে বাংলাদেশি পাসপোর্টসহ তিন রোহিঙ্গাকে আটক করে পুলিশ। তারা তুরস্কের ভিসার আবেদন করার জন্য ঢাকায় যাচ্ছিল বলে স্বীকার করেছে।

অন্যদিকে বাংলাদেশি পাসপোর্ট বাগিয়ে ইতিমধ্যে বিদেশে পাড়ি জমানো রোহিঙ্গার সংখ্যাও নেহায়েত কম নয় বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। পুলিশ ও পাসপোর্ট অফিসের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বলছেন, আটক হওয়া ব্যক্তিদের প্রত্যেকের কাছেই ওয়ার্ড কাউন্সিলর অথবা ইউপি চেয়ারম্যানের সনদ পাওয়া গেছে। এর সব সনদ জাল নয়। তবে ভুয়া নাম, ঠিকানা ব্যবহার করে দালালের মধ্যস্থতায় রোহিঙ্গারা জাতীয় পরিচয়পত্র ও জন্মসনদ তৈরি করছেন। বিপুল অর্থের বিনিময়ে এক শ্রেণির অসত্ জনপ্রতিনিধি রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশি সনদ পাওয়ার সুযোগ করে দিচ্ছেন। রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশি নাগরিক বানানোর প্রক্রিয়ায় জেলা নির্বাচন কার্যালয়ের অসত্ কর্মকর্তা— কর্মচারিরাও পিছিয়ে নেই। অভিযোগ রয়েছে, দালাল চক্রের সহযোগিতায় ভোটার তালিকায় রোহিঙ্গাদের নাম অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে। সম্প্রতি বন্দুকযুদ্ধে নিহত রোহিঙ্গা ডাকাত নূর মোহাম্মদ ওরফে নূর আলমের কাছে বাংলাদেশি জাতীয় পরিচয়পত্রের স্মার্ট কার্ড পাওয়ার বিষয়টি সারাদেশে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। রোহিঙ্গারা যাতে জাতীয় পরিচয়পত্র বা পাসপোর্ট পেতে না পারে সেজন্য ওয়ার্ড পর্যায়ে সনদ দেওয়ার ক্ষেত্রে যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়ায় আরো সতর্কতা অবলম্বনের প্রয়োজন রয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা অভিমত ব্যক্ত করেন। এ ধরনের অপকর্মে জড়িত জনপ্রতিনিধিদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত্ বলে তারা উল্লেখ করেন।

রোহিঙ্গারা যাতে বাংলাদেশি পাসপোর্ট পেতে না পারে সেজন্য চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশ ১৮ দফা নির্দেশনা দিয়েছে। নগর পুলিশের বিশেষ শাখার উপ-কমিশনার আবদুল ওয়ারিশ বলেন, আমরা তদন্তকারী কর্মকর্তাদের যে নির্দেশনা দিয়েছি, সেগুলো অনুসরণ করলে ভুয়া ঠিকানা ব্যবহার করে কেউ পাসপোর্ট সংগ্রহ করতে পারবে না। এসব নির্দেশনায় বলা হয়েছে, ২০০০ সালের আগে যাদের জন্ম তাদের ক্ষেত্রে অবশ্যই জাতীয় পরিচয়পত্র জমা দিতে হবে। তা অনলাইনে যাচাই করে যাচাইকারী কর্মকর্তার স্বাক্ষর নিতে হবে। অপ্রাপ্ত বয়স্ক এবং যাদের এনআইডি নেই, তাদের মা-বাবার এনআইডি যাচাই করতে হবে। আবেদনকারীর ছবি যাচাইয়ের পাশাপাশি ওয়ার্ড কাউন্সিলরের সনদ, সত্যায়নকারীর পরিচয় এবং সত্যায়ন করেছেন কিনা তা নিশ্চিত হতে হবে। নির্দিষ্ট ঠিকানায় তথ্য পাওয়া না গেলে আবেদনকারীর ভূমিহীন সনদ, তার বিরুদ্ধে কোনো ফৌজদারি মামলা আছে কিনা, সেসব তথ্যও যাচাই করতে হবে। এছাড়া আবেদনকারীকে চেনেন এমন স্থানীয় দুই ব্যক্তির নাম ও মোবাইল নম্বর নিতে বলা হয়েছে তদন্তকারী কর্মকর্তাদের। 

জানা গেছে, সম্প্রতি চট্টগ্রামের দুটি পাসপোর্ট অফিস থেকে পরিচয় গোপনকারী বেশ কয়েকজন পাসপোর্ট আবেদনকারী রোহিঙ্গাকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে তুলে দেওয়া হয়। এর মধ্যে গত ২২ আগস্ট সীতাকুণ্ডের জঙ্গল লতিফপুর এলাকার ঠিকানা ব্যবহার করে পাসপোর্টের আবেদন করেন মো. ফয়সাল নামে এক ব্যক্তি। তিনি জন্মনিবন্ধন ও বাংলাদেশি জাতীয়তা সনদ জমা দিলেও আঙ্গুলের ছাপ দিতে গেলে তা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ডাটাবেজে থাকা আঙুলের ছাপের সঙ্গে মিলে যায়। এতে প্রমাণিত হয় তিনি রোহিঙ্গা। চট্টগ্রাম বিভাগীয় পাসপোর্ট অফিসে গত ৫ সেপ্টেম্বর শফিকুল হাই নামে আরেকজন ধরা পড়েন। তিনিও জাতীয় পরিচয়পত্র ও জাতীয়তা সনদ জমা দেন। তবে পাসপোর্ট কর্মকর্তাদের সন্দেহ হলে জিজ্ঞাসাবাদে নিজেকে রোহিঙ্গা বলে স্বীকার করেন শফিকুল। গত ২২ আগস্ট সুমাইয়া আক্তার নামে আটক এক রোহিঙ্গা নারীর পাসপোর্ট আবেদনের সঙ্গে দেওয়া জন্মনিবন্ধন সনদটি ইস্যু করা হয়েছে চট্টগ্রাম নগরীর পাঠানটুলি ওয়ার্ড থেকে। পাঁচলাইশ পাসপোর্ট কার্যালয় সূত্র জানায়, তাদের হাতে রোহিঙ্গা সন্দেহে আটক ২৮ জনের মধ্যে ১২ জন তাদের পাসপোর্ট আবেদনের সাথে জাতীয় পরিচয়পত্র জমা দেয়, বাকিরা দিয়েছে জন্মনিবন্ধন সনদ।

চট্টগ্রাম বিভাগীয় পাসপোর্ট ও ভিসা অফিসের পরিচালক আবু সাইদ বলেন, রোহিঙ্গারা তাদের পাসপোর্ট আবেদনের সঙ্গে জন্মনিবন্ধন, জাতীয়তা সনদ ও জাতীয় পরিচয়পত্র জমা দিচ্ছেন। এগুলো কোনো না কোনো জনপ্রতিনিধির দেওয়া। এগুলো কিন্তু জাল সনদ নয়। তাই আবেদনকারীকে আইনগতভাবে ধরার কোনো সুযোগ থাকে না। কিন্তু আবেদনকারীর চালচলন ও কথাবার্তায় সন্দেহ হলে আমরা তাদেরকে রোহিঙ্গা হিসেবে শনাক্ত করে পুলিশের হাতে তুলে দিচ্ছি।

পাঁচলাইশস্থ আঞ্চলিক পাসপোর্ট কার্যালয়ের উপ-পরিচালক আল আমিন মৃধা বলেন, রোহিঙ্গারা যাতে জন্ম, জাতীয়তা সনদ এবং জাতীয় পরিচয়পত্র সংগ্রহ করতে না পারে সেজন্য মাঠ পর্যায়ের সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে। কোনো ব্যক্তিকে সনদ দেওয়ার আগে তার দেওয়া তথ্য সঠিক কিনা, সেটা জনপ্রতিনিধিরা যাচাই করে নিলে রোহিঙ্গারা পাসপোর্টের জন্য সহজে আবেদন করতে পারবে না।