বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

নোমানের পরিবেশবান্ধব পাটের সাইকেল

আপডেট : ০৩ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ১৯:৪৪

>> মুহাম্মদ শফিকুর রহমান

 

নোমান তখন খুব ছোট। বড়োদের কাছে শুনলেন, আদামজী পাটকল বন্ধ হয়ে যাওয়ার কথা। সবাই দুঃখ প্রকাশ করছিল। নোমান তখন ভাবলেন, পাট শিল্প বাঁচিয়ে রাখতে কী করা যায়, পাটের ব্যবহার কিভাবে বাড়ানো যায়। ছোট্ট নোমান একদিন বড়ো হলেন। ২০০৫ সালে ঢাকা পলিটেকনিকে ভর্তি হন। এরপর সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করলেন। কিছুদিন চাকরি করেন। ২০১২ সালের দিকে সাইকেল বানানোর ভাবনা তার মাথায় আসে। ছাত্রাবস্থায় একটি সাইকেল পছন্দ হয়েছিল তার। নোমান বলেন, ‘ইউরোপিয়ান মডেলের সাইকেল ছিল সেটি। দাম প্রায় পাঁচ থেকে ছয় লাখ টাকা। তখন তো আমার এত টাকা ছিল না। তখন সাইকেল বানানোর ভাবনাটা আরো পোক্ত হলো, কিভাবে কম খরচে টেকসই সাইকেল বানানো যায়, যা হবে পরিবেশবান্ধব।’ নোমান জানালেন, এক কেজি অ্যালুমিনিয়াম বা এক কেজি স্টিল তৈরি করতে প্রচুর পানি নষ্ট হয়, যেটা আর পরে ব্যবহারই করা যায় না। কার্বন ফাইবার তৈরি করতেই প্রচুর পরিমাণ কার্বন-ডাই-অক্সাইড তৈরি হয়। সে জায়গা থেকে এটা বেশি পরিবেশবান্ধব বলাই যায়।’ ২০১৪ সালে নোমান বাইসাইকেল বানানোর কারখানা করেন। ২০১৫ সালে পাটের তৈরি সাইকেল বানানোর কাজ শুরু হয়। পাটকে আমরা যতটা পচনশীল ভাবি, আসলে তা নয়। নোমান বলেন, ‘একটা গামছার একদিক নরম অন্যদিক শক্ত থাকে। শক্ত দিকটা বিভিন্ন কেমিক্যাল দিয়ে আর শক্ত করা যায়। পাটের আঁশও প্রসেসিং করে শক্ত করা হয়েছে। চার বছর নিরলস পরিশ্রম করে নোমান সফলতার মুখ দেখেন। প্রায় লাখ খানেক টাকা বিনিয়োগ করেন। এই টাকা কবে উঠে আসবে, তা জানা নেই। শুরুটা তার জন্য অনেক কঠিন ছিল। নোমান বলেন, ‘শুরুটা অনেক কঠিন ছিল। ঘনত্ব কী রকম হবে, কোন আঁশটা ব্যবহার করব, তাতে কাজ হবে কি না—এরকম ভাবনা ছিল। যদিও কাগজে-কলমে জানতাম যে হবে, কিন্তু করার সময় আত্মবিশ্বাস পাচ্ছিলাম না।’ ২০১৪ সালের শেষের দিকে নোমান প্রথম পাটের আঁশের ফ্রেম তৈরি করেন। যার ওজন ছিল ২ কেজি ৮০০ গ্রামের মতো। পরে এই ওজন তিনি কমিয়ে নিয়ে আসেন।

ফ্রেম তৈরি পদ্ধতি সম্পর্কে নোমান বলেন, ‘অনেক শক্ত পাটের তৈরি পাইপ, যা দিয়ে আমি বাইসাইকেল বানাই। একটা স্টিলের পাইপের উপরে পাটের কাপড় প্যাঁচানো হয় আঠা দিয়ে। শুকানোর পরে এটাকে খোলা হলে একটা আকার চলে আসে। এরপর, এটাকে কেটে আপনার প্রয়োজন অনুসারে যেভাবে দরকার ব্যবহার করতে পারেন। আপাতত শুধু ফ্রেম পাট দিয়ে তৈরি করা। বানানোর পদ্ধতি যতটুকু জানতে পেরেছি তাতে হ্যান্ডেলবার, ফর্ক, রিম, স্যাডেল, স্ট্যান্ড—এগুলো পাট দিয়ে বানানো সম্ভব। তবে, বানানো সম্ভব না টায়ার, টিউব ও চেইন।’ ফ্রেম বানাতে খুব বেশি মেশিনপত্র নোমান ব্যবহার করেন না। আধুনিক যন্ত্রপাতিও তার তেমন নেই। টেকসই কেমন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘৫০ বছরেও কিছু হবে না। মানে একটা জেনারেশন চালাতে পারবে, কিছু হবে না।’ ভবিষ্যতে সাইকেলের হ্যান্ডেলবার, সিট পোস্ট, রিম, ফর্কও পাট দিয়ে বানানোর চেষ্টা করবেন তিনি। পাট দিয়ে সুন্দর সব আসবাবপত্র তৈরি হয়। তৈরি হয় ঢেউটিন। এসব বিবেচনায় সাইকেলও তৈরি করা সম্ভব। সে কথাই বলছিলেন বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউটের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মোসলেম উদ্দিন। তিনি বলেন, ‘পাট দিয়ে ঢেউটিন বানানো গেলে সাইকেল বানানোও সম্ভব।’ বাই সাইকেল স্পেশালিস্ট আবু নোমান সৈকত গত কয়েক বছরে ৩৫০টিরও বেশি সাইকেল তৈরি করেছেন। প্রচণ্ড আশাবাদী তিনি। একই সঙ্গে পরিশ্রমী। তিনি মনে করেন, কিছুদিনের মধ্যে পাটের সাইকেলও মানুষের হাতে তুলে দিতে পারবেন। একদিন বিশ্বের সবচেয়ে বড়ো হ্যান্ডমেইড সাইকেলের কারখানা গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখেন উদ্যমী এই তরুণ।

 

 

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন