শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

চুরি বিদ্যা বড়ো বিদ্যা!

আপডেট : ০৬ আগস্ট ২০১৯, ২১:১৪

চিররঞ্জন সরকার

এক গ্রামে দুই প্রতিবেশী বাস করত। একজনের নাম খগেন আরেকজনের নাম নগেন। তাদের মধ্যে খুব বন্ধুত্ব ছিল। কিন্তু শেষ বয়সে গিয়ে বন্ধুত্বটা টিকল না। নগেনের একটি ছাগল খগেনের একটি চারাগাছ খেয়ে ফেলার ঘটনা নিয়ে দুই জনের মধ্যে ভীষণ বিবাদ বাধল। শুরু হলো রেষারেষি। একে অপরকে ঠেস মেরে কথা বলে, রাগ দেখায়, তৃতীয় কাউকে সামনে পেলে চিত্কার করে একে-অপরের বদনাম করে।

খগেন ভেবে দেখল যে, নগেনের সঙ্গে কলহ বাঁধিয়ে অশান্তি ভোগ করার চেয়ে কিছুদিন তীর্থভ্রমণ করে আসা ভালো। এই ভেবে সে ‘পুরুষোত্তম ক্ষেত্র’ পুরী যাওয়ার জন্য একটি শুভ দিন ঠিক করল। ঘটনা শুনে খগেন দুশ্চিন্তায় পড়ে গেল। নগেন যদি গ্রাম ছেড়ে চলে যায় তবে তো আর তাকে কথা শোনানো যাবে না। তাই সে ঠিক করল যে কোনো উপায়ে তাকে এই গ্রামে রাখতে হবে এবং সবসময় বিবাদের মধ্যে তাকে ফেলতে হবে। খগেন জানত যে নগেনের কতকগুলো কুসংস্কার আছে। কোথাও যাত্রাকালে নাক কাটা লোককে দেখলে তা অমঙ্গলের বার্তা বলে সে মনে করে থাকে।

তাই যেদিন খগেন পুরী যাওয়ার জন্য তৈরি হলো সেদিন ঠিক তার বেরোবার মুহূর্তে নগেন নিজের নাক কেটে ফেলল। খগেন ঘরের সামনের রাস্তায় পা দিতেই নাক কাটা অবস্থায় নগেনকে দেখতে পেল। আর তার পুরী যাওয়া হলো না! সেই থেকে চালু হলো প্রবাদ: নিজের নাক কেটে অপরের যাত্রা ভঙ্গ করা!

বাংলা ভাষা ছাড়া অন্য কোনো ভাষায় এ ধরনের প্রবাদ বাক্য খুঁজে পাওয়া যাবে না। বিভিন্ন প্রবাদ-প্রবচনে ফুটে ওঠে কোনো জাতির স্বভাব-চরিত্র-বৈশিষ্ট্য। আমাদের জাতিগত বৈশিষ্ট্যও খুঁজে পাওয়া যায় এ ধরনের প্রবাদ-প্রবচনে। তেমনই আরেকটি প্রবাদ হচ্ছে: ‘চুরি বিদ্যা বড়ো বিদ্যা যদি না পড় ধরা’। এই প্রবাদটি অন্য কোনো ভাষায় আছে বলে মনে হয় না। এটা শুধু বাংলাতেই আছে। আর একথাও কবুল করা ভালো যে, এই বিদ্যায় কোনো কোনো বাঙালির ব্যুত্পত্তি প্রশ্ন্নাতীত। বাবার পকেটের টাকা, প্রতিবেশীর গাছের আম-জাম-পেয়ারা-লিচু দিয়ে শুরু হলেও বাঙালি পুকুরচুরিতেও পাকা। চুরির বস্তু হিসেবে পুকুরও এখন বড় কিছু নয়। খাল-বিল, হাওর-বাঁওড়, বনভূমি, নদী ও পাহাড় পর্যন্ত চুরি হচ্ছে। সোনাদানা তো অতি ছোটো বস্তু। তবে আমাদের দেশে বর্তমানে সবচেয়ে বেশি যা চুরি হয়—তা হলো টাকা। অবশ্য চুরি না বলে একে ‘হাতিয়ে নেওয়া’ বলাই ভালো। এর কারণ কি? এর সহজ উত্তর হচ্ছে, টাকা নেই বলেই চোর চুরি করে! তবে সব চোর যে টাকা নেই বলেই চুরি করে—তা কিন্তু নয়। অনেকেই আছে, চুরি করা যাদের স্বভাব। চুরি ছাড়া যারা থাকতে পারে না। তবে আমাদের দেশে ছোটোলোক চোরের চেয়ে বড়োলোক চোর বেশি। কারণ বড়োলোকদের আছে টাকার নেশা। এই নেশায় আচ্ছন্ন হওয়ার কারণে তারা কারণে-অকারণে চুরি করে, সব সময় চুরির ধান্দাতেই তাদের সময় কাটে।

চোর নিয়ে আমাদের দেশে কিন্তু অনেক প্রবাদ আছে। এর মধ্যে কিছু আছে বহুল ব্যবহূত। যেমন: চোরের মায়ের বড়ো গলা, চোরে চোরে মাসতুতো ভাই, চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ে, চোরের সাক্ষী মাতাল, যার জন্য চুরি করি সেই বলে চোর, অতি ভক্তি চোরের লক্ষণ, চোরায় না শোনে ধর্মের কাহিনি ইত্যাদি। তবে ছিঁচকে চুরি থেকে পুকুর-সমুদ্র চুরি, যে চুরিই হোক, নিরাপদে সারতে পারাটাও বিরাট কৃতিত্ব। পুকুর চুরি অর্থাত্ বড়ো ধরনের চুরি- এই যেমন রাষ্ট্রীয় কোটি টাকা পাচার কিংবা লাখ টাকা ঘুষ বাবদ গ্রহণ করলে তিনি গণমাধ্যমে আলোচিত বা ‘হিরো’ হয়ে যান। দিনের পর দিন তাকে নিয়ে সচিত্র প্রতিবেদন ছাপা হয়। আলোচনা হয়। সে তুলনায় ছোটোখাটো চোররা অনালোচিত থেকে যান। তাদের খোঁজ নেয় না কেউ। সাধারণ জনগণ দু একটি চড়-থাপ্পড় দিয়ে বিদায় করে দেয়। ভাগ্য খারাপ হলে হয়তো কিছুটা বেশি শাস্তিও পেতে হয়!

চুরি আসলে এক ‘চমত্কার’ আর্ট। কমবেশি অনেকেই এ বিদ্যা চর্চা করে। কিন্তু ধরা পড়ে খুব কম জনই। আর এর সুবিধা হলো, ধরা না পড়া পর্যন্ত কাউকে চোর বলাও যায় না!

চুরিটা আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে এমনভাবে মিশে গেছে, এ নিয়ে কেউ তেমন আর মাথা ঘামায় না। তবে মাঝেমধ্যে দু একটি বড়ো চুরির ঘটনা ধরা পড়ে বা উদ্ঘাটিত হয়। তখন আমরা খানিকটা হইচই করি। ধর্মের বাণী স্মরণ করি। ব্যস। তারপর যেই লাউ সেই কদু। আমরা আবার চুরির মওকা খুঁজি। চুরি বিদ্যার চর্চা অব্যাহত রাখি। আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ নানা দিক থেকেই অনন্য, অসাধারণ। চুরি করে বড়োলোক হওয়ার মতো এমন সুন্দর অনুকূল পরিবেশ পৃথিবীর অন্য কোথাও আছে বলে মনে হয় না। তাইতো এখানে কমবেশি সবাই বড়োলোক হবার বাসনায় চুরি করেন। ঘুষ খান, দুর্নীতি করেন।

অবৈধ পন্থায় ঘুষ-দুর্নীতির মাধ্যমে আমাদের দেশে টাকা উপার্জন অনেকেই করেন। শত শত হাজার হাজার কোটি টাকা। কিন্তু তাদের মধ্যে ধরা পড়ে কজন? ঢাকা শহরের এমন অনেক আলিশান বাড়ি ও দামি গাড়ির মালিকদের খোঁজ নিলে দেখা যাবে, তাদের এ অর্জন অবৈধ পন্থায় ঘুষ-দুর্নীতির টাকায়। এরটা মেরে, ওরটা কেড়ে, ঠকিয়ে-প্রতারণা করে, বিপদের সুযোগ নিয়ে, ফাঁসিয়ে দিয়ে কিংবা ঘুষ-দুর্নীতির চোরাপথ ছাড়া এদেশে বড় ধনী হওয়া যায় না। আর সেটা সবাই পারেও না। আসলে টাকা উপার্জন করাটা যেমন একটা আর্ট, উপার্জিত টাকা সকলের অগোচরে ‘সংরক্ষণ, পরিচর্যা ও রক্ষণাবেক্ষণ’ করতে পারাটাও একটা আর্ট। এই আর্ট সবাই রপ্ত করতে পারে না। এর জন্য সাধনা লাগে। দক্ষতা অর্জন করতে হয়। ম্যানেজ করতে জানতে হয়। পুকুর চুরি করে সেই পুকুর আড়াল করে রাখা বা গায়েব করে দেওয়াটা সহজ বিদ্যা নয় মোটেই। অনেকেই সেটা পারেন এবং করেন। কিন্তু আমাদের সমাজে কিছু কিছু আনাড়ি চোরও আছে। যেমন সম্প্রতি সিলেটের কারা উপ-মহাপরিদর্শক (ডিআইজি প্রিজনস) পার্থ গোপাল বণিকের বাসায় অভিযান চালিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন যে ৮০ লাখ টাকা উদ্ধার করেছে। ‘আড়াল করবার বিদ্যা’ অর্জন ছাড়াই ঐ ব্যক্তি যেভাবে অবৈধ উপায়ে উপার্জিত অর্থসহ ধরা পড়ল তাতে লোকটির প্রতি তীব্র ঘৃণা ও ক্ষোভ জন্ম নিয়েছে। দুর্নীতি দমন কমিশন, রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে সামান্য ৮০ লাখ টাকা যে ‘গোপন’ বা ‘হজম’ করতে পারেনি, ম্যানেজ করতে পারেনি, তার আসলেই কঠিন শাস্তি হওয়া উচিত! হাত-পা ভেঙে তিন রাস্তার মোড়ে খাঁচায় ভরে রাখা উচিত! যাতে তাকে দেখে অন্যসব শিক্ষানবিস চোর শিখতে পারে যে চুরি করলেই কেবল হবে না, চোরাই মাল ‘হাপিস’ করে দেবার দক্ষতা আগে অর্জন করতে হবে।

এইসব আনাড়ি চোরের কারণে দেশ এবং সরকারের ভাবমূর্তির বারোটা বাজছে। অথচ যারা কঠিন-কঠোর মানি লন্ডারিং আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে, সরকার-প্রশাসন-গোয়েন্দা-গণমাধ্যমকে ভেড়া বানিয়ে অত্যন্ত কৌশলে হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার করছে, বিভিন্ন দেশে দোকান-বাড়ি-জায়গা জমি কিনছে, ভবিষ্যত্ প্রজন্মকে লেখাপড়ার নামে পাঠিয়ে দিচ্ছে, তারা কিন্তু চিহ্নিত হচ্ছে না। এতে দেশের ভাবমূর্তিরও কোনো রকমফের হচ্ছে না! এদের কাছে শেখার আছে অনেক কিছু। কিন্তু পার্থ গোপাল বণিকরা কিছু শিখেছে বলে মনে হয় না। তা না হলে এই যুগে টাকার বস্তা ছাদে রেখে কেউ বলদের মতো ‘লুকোচুরি’ খেলে? কিসের রবীন্দ্রনাথ, কিসের পিকাসো, আমাদের দেশে অধরা অনির্ণীত। বড়ো বড়ো চোরেরাই প্রকৃত ‘আর্টিস্ট’। প্রকৃত শিল্পীসত্তা। অসম্ভব শিল্পিত কায়দায় যারা ব্যাংক থেকে, শেয়ার বাজার থেকে, বিদ্যুত্খাত থেকে, আমদানি-রপ্তানির নামে সকলের অজান্তে কোটি কোটি টাকা মেরে দিচ্ছেন, রাষ্ট্রের চেয়েও যারা বেশি ক্ষমতাবান। আসলে তারাই মানুষ তারাই দেবতা! আসুন দল বেঁধে সবাই আজ ‘গাহি তাহাদের গান!’

n লেখক: রম্য রচয়িতা