শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

অভিমুখ খনোমা

আপডেট : ২৫ জুলাই ২০১৯, ২০:০১

যাত্রাপথে নাগাল্যান্ড আছে শুনে সঙ্গিনী জিজ্ঞেস করে :ছাই-ভস্ম মেখে নগ্ন হয়ে কুম্ভমেলায় যোগ দেয় যে সন্ন্যাসীরা সেই নাগাদের দেশ?

ছোট ছেলে জিজ্ঞেস করে, নাগা মানে নরমুণ্ড শিকারিরা? উত্তরের অপেক্ষা না করেই উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে—দারুণ হবে!

দুই প্রশ্নই চিন্তায় ফেলার মতো। আসল চিন্তার কথা তো এদেরকে বলিনি, বলতে চাইও না এখন। তা হচ্ছে আমাদের এবারের যাত্রাপথের জন্য নিতে হবে আইপি বা ইনার লাইন পারমিট। ভারতীয়দেরও লাগে। আমরা প্রতিবেশী দেশ হলেও বিদেশি। আদৌ আমাদের ইনার লাইন পারমিট দেবে কি না যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে।

তবু রওনা হই এই ভরসায় যে, যাচ্ছি সপরিপারে এবং দুজন স্কুলের নিচের ক্লাসে পড়ুয়া আছে সঙ্গে। এই ভরসা আমাদের পৌঁছ দেয় একে একে আগরতলা থেকে শিলচর, শিলচর থেকে ইম্ফল এবং সেখান থেকে গোহাটিগামী বাসে নাগাল্যান্ডের রাজধানী কোহিমায়। ইম্ফল থেকে দূরত্ব ১৩৫ কিলোমিটার। রাস্তা পাকা, ভালো, কিন্তু পৌঁছাতে দুপুর হয়ে যায় কারণ পথে পথে সেনাবাহিরীর চেকপোস্ট। একটা নয় অনেকগুলো। এর আগে শিলচর থেকে ইম্ফল ২৬৩ কিলোমিটারে পেয়েছিলাম ২২টি। ইম্ফল থেকে কোহিমা যেতে পেলাম এর অর্ধেক। বাস থেকে নেমে যার যা আছে তা-ই নিয়ে কিছুটা হেঁটে চেকপোস্টে রাখা বেঞ্চ বা কাঠের তক্তা রাখা যেখানে, সেখানে যেয়ে ব্যাগ-ট্যাগ সব খুলে দেখাতে হয়। আমরা সপরিবারে এবং সঙ্গে দুজন কমবয়সী থাকায় কিছু সুবিধা পেলাম। ব্যাগ অনেক জায়গায় খুলতে হয়নি। ব্লু হিল নামের গোহাটিগামী ট্যুরিস্ট বাস আমাদের নামিয়ে দিল প্রধান রাস্তায়—যা গেছে কোহিমার শহরের মাঝ দিয়ে। 

মাঝ শহর হলেও বেশ নিরিবিলি। ভূ-পৃষ্ঠ থেকে পাঁচ হাজার ফুট উঁচুতে কোহিমা পাহাড়ি শহর। রিকশা নেই, নেই বেবি ট্যাক্সিও। তবে ট্যাক্সি আছে। একটা গরিব লোক এসে লাগেজের কাছে দাঁড়য়। জানায়, সামান্য হাঁটলেই হোটেল পাওয়া যাবে। সে-ই বাড়তি ব্যাগ তুলে নেয়।

তো হোটেল পাওয়া গেল, কিন্তু খাব কোথায়? এ হোটেলে শুধু আবাসিক সুবিধা পাওয়া যায়।

রাস্তায় লোক কম, রেস্টুরেন্ট আরো কম। যা-ও পেলাম, বাইরে থেকে বোঝা যায় এগুলো নাগাদের। নাগারা সব খায়, শেষে কি না কী খেতে দেবে। না পারব খেতে না পারব ফেরত দিতে। শেষে বমিটমি করে বিচ্ছিরি একটা ঘটনা না ঘটে।

বিদেশ-বিভুঁই হলেও বাঙালি পাওয়া গেল। একটা বড় ভবনের নিচে কাপড়ের দোকানির গায়ে পাঞ্জাবি এবং মুখে দাড়ি দেখে পরিচয় জিজ্ঞেস করে জানা গেল, নাম নুরুল্লাহ মিঞা, বাড়ি চট্টগ্রাম। এখানে আছেন অনেকদিন। তিনিই জানালেন—সামনে মূল রাস্তার সামান্য নিচের রাস্তায় আফতাব উদ্দিনের রেস্টুরেন্ট, বাড়ি নোয়াখালী।

রেস্টুরেন্টটা আমি একটু আগে দেখেছি। বললাম, ওটা তো নাগাদের। সামনে একটা নাগা মেয়ে বসে। নুরুল্লাহ মিঞা হেসে বললেন, ওটা আফতাব উদ্দিনেরই রেস্টুরেন্ট। নাগা ছেলেরা চাঁদা চায় দেখে একটা নাগা মেয়ে বসিয়েছে সামনে কাউন্টারে। বুঝলাম একই ট্র্যাডিশন চলছে।

রুমবন্দির সময়টাকে কাজে লাগাতে সঙ্গে থাকা নাগাল্যান্ডের গাইড বই খুলে বসলাম।

এই রাজ্যের আয়তন ১৬,৪৮৮ বর্গকিলোমিটার বা ৬,৩৬৬ বর্গমাইল। ১৯৯১ সালের আদমশুমারি অনুসারে লোকসংখ্যা ১২,১৫,৫৭৩ জন। ১৯৬৩ সালের ১ ডিসেম্বর ভারতের ১৬ নম্বর রাজ্যের মর্যাদা পায় নাগাল্যান্ড।

একসময় নাগারা ছিল হিংস্র ও অত্যাচারী। তারা থাকত উলঙ্গ বা নাঙ্গা। তা থেকে তাদের পরিচয় হয় নাগা বলে। এখন আর আগের মতো নরমুণ্ড শিকার করে না। নাঙ্গা বা ন্যাংটাও থাকে না। ইংরাজি মাধ্যমে পড়াশোনা করা আধুনিক পোশাক পরা গিটার বাজিয়ে ইংরেজি গান গাওয়া নাগারা এখন এক দ্রুত উন্নয়নশীল জাতি। শুধু পালা-পার্বণে পরে ঐতিহ্যবাহী পোশাক।

বারো লাখ লোকের এই রাজ্যে রয়েছে ১৬টি আদিবাসী—আও, অঙ্গামি, সেমা, লোথা, রেঙ্গমা, ইমচুঙ্কার, খিয়ামুঙ্কার, জেলিয়াঙ, কুকি ও পচারি। প্রায় সব আদিবাসীরই আছে নিজস্ব ভাষা।

 

২.

পরদিন সকালে যখন বেরুলাম তখন আকাশ পরিষ্কার, ঝকঝকে রোদ, রাস্তায় লোকজন। চট্টগ্রামের নুরুল্লাহ মিঞাই ট্যাক্সি ঠিক করে দিলেন। এন এল ওয়াই-৩৫১, ড্রাইভারের নাম দিলীপ থাপা, নেপালি, সঙ্গে রয়েছে দেশ থেকে নতুন আসা ছোটভাই। তাকেও সঙ্গে নিল। অ্যামবাসাডার ট্যাক্সিতে একটু চাপাচাপি করে বসা গেল।

আমাদের নিয়ে বসানো হলো গ্রাম পঞ্চায়েতের মিটিং হয় যেখানে। বসার ব্যবস্থা বেশ মজার। পাথর কেটে বানানো আসন। অর্ধবৃত্তাকারে তিন সারি, সামনে বসেন গ্রামপ্রধান ও সহপ্রধান।

প্রিন্সিপাল সাহেব শিক্ষিত, বলতেও পারেন ভালো। প্রথমে জানালেন নাগাদের আদি ইতিহাস সম্পর্কে।

পণ্ডিত ব্যক্তিদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে নাগাদের আদিনিবাস এমনকি ‘নাগা’ শব্দটি নিয়েও। একদল শব্দতত্ত্ববিদের মতে, নাগা শব্দটি এসেছে বার্মিজ ভাষা থেকে, যার অর্থ কান ছিদ্র করা মানুষ। নাগাদের ভেতর কান ছিদ্র করা খুবই প্রচলিত একটি প্রথা। এমনকি কান ছিন্দ্র করা একটি সামাজিক উত্সবও। আট থেকে বারো বছরে বয়সের মধ্যে ছেলেদের কান ফোঁড়ানো হয়। শুভদিন দেখে একসঙ্গে একদল ছেলের কানের লতিতে বাঁশের সূক্ষ্ম শলাকা দিয়ে ছিদ্র করে কোনো দক্ষ যোদ্ধা বা শিকারি। তার আগে একটি বড় পুরুষ শূকর বধ করেন গ্রামপ্রধান। শূকরের মাংস প্রতিবেশীদের মধ্যে বিলি করা হয়। কান ফোঁড়ানোর পরে সেই ছেলেটি অধিকার পায় সামাজিক নাচের আসরে যোগ দেওয়ার।

অন্যমতে, নাগা শব্দটি এসেছে কথ্য অহমিয়া ভাষা ‘নোগা’ থেকে। নোগা মানে ন্যাঙটা বা উলঙ্গ। এ কথাটা আমরা সহজেই বিশ্বাস করলাম কারণ আজ আসার পথে দেখেছি অর্ধউলঙ্গ নাগা তরুণীদের।

কালক্রমে ‘নোগা’ থেকে রূপান্তরিত ‘নাগা’ শব্দটি বার্মা, মনিপুর, আসাম ও পৃথক রাজ্য নাগাল্যান্ডের এক বৃহত্ ও পৃথক আদিবাসী গোষ্ঠীর পরিচয় হয়ে দাঁড়ায়।

পণ্ডিতদের মতে, নাগাদের আদি নিবাস ছিল চীনের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলে। সেখান থেকে তারা দেশান্তরী হয়ে নিবাস বাঁধে বার্মায়। পরে এগিয়ে আসে পূর্বদিকে। নাগাদের ব্যবহূত অলংকার, বৃহদাকার ঢাক ও বাদ্যযন্ত্র দেখে অনেক পণ্ডিতের ধারণা, নাগারা সম্ভবত ইন্দোনেশিয়ার জাভা ও সুমাত্রা দ্বীপাঞ্চল থেকে দেশান্তরী হয়ে এদেশে এসেছে। পৃথিবীর মানুষের শ্রেণিবিভাগ অনুসারে নাগারা তিব্বত-বর্মি গোষ্ঠীর অন্তর্গত।

খনোমা  গ্রামটি বড় হলেও বাড়ির সংখ্যা মাত্র পাঁচশো। লোকসংখ্যা তিন হাজার। গ্রামের মানুষের প্রধান পেশা কৃষি। শিক্ষিত লোকেরা চাকরি এবং ব্যবসা পেশায়ও যোগ দিচ্ছে। প্রিন্সিপাল সাহেবের কাছ থেকে জানা গেল মজার তথ্য—প্রতিটি গ্রামে ‘খেল’ বা দুই অংশে বিভক্ত থাকে। প্রতিটি গ্রামে থাকে একটি করে ভিলেজ কাউন্সিল। এই ভিলেজ কাউন্সিল পুরো গ্রামটিকে নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা করে থাকে। নাগাদের গ্রামের জমি ব্যক্তিমালিকানায় নয়, জমির মালিকানা ওই গ্রামের জাতি বা গোত্রের। প্রতি বছর গোত্রপ্রধান ঠিক করে দেন জমি কীভাবে চাষ করা হবে এবং কারা করবে। সেই অনুসারে গ্রামের পরিবারদের মধ্যে জমি ও কাজ ভাগ করে দেওয়া হয়—এর ভেতরে কোনো হিংসা, ঈর্ষা, প্রতিবাদ বা শত্রুতার অবকাশ নেই। ভিলেজ কাউন্সিল কাজের দায়িত্ব বণ্টন করে পুরো গ্রামের মানুষের চাহিদা ও প্রয়োজন মেটায়। গ্রামের প্রতি দায়িত্ব গ্রামের সব মানুষের। এজন্য নাগারা যেমন পরিবারের প্রতি অনুগত তেমনি অনুগত ভিলেজ কাউন্সিলের প্রতিও। গ্রামের ছেলেরা বাস করে একত্রে। হোস্টেলের মতো বড় ঘরে। তাদের প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় ‘মোরাঙ’ নামের যুব ক্লাবে। নাগা যুবকের জন্য তার গ্রামই হচ্ছে পৃথিবী। এখানেই তাকে শিখতে হয় শিকার ও যুদ্ধের কলাকৌশল, গোত্রের নিয়মনীতি। ভিলেজ কাউন্সিল তার পেশা পছন্দ করে দেয়। নাগা যুবক গ্রাম থেকেই পছন্দ করে নেয় বিয়ের কনে।

নাগাদের বাড়িঘরও মজার। বাঁশের বা কাঠের খুঁটির ওপর মাচাঙ ঘর। ঘরের চাল টিনের, কিন্তু মজবুত। সামনের দিকটা যুদ্ধ ও শিকারে পাওয়া পশুর মুণ্ডুর স্মারকচিহ্ন দিয়ে সাজানো। দু ধরনের ঘর হয়। দলবদ্ধ বাসের জন্য চল্লিশ বা পঞ্চাশ ফুটের লম্বা ঘর। নয়তো সপরিবারে বসবাসের জন্য দুই অংশে বিভক্ত বাড়ি। প্রথম বা সামনের অংশ হচ্ছে গৃহপালিত পশু যথা—গরু, শূকর বা মুরগি রাখার জন্য। দ্বিতীয় অংশে বাস করে বাড়ির মানুষ। শয়ন ও রান্না একই ঘরে, অতিথি এলে সেও বাস করে সেই ঘরে। চুল্লিতে আগুন জ্বলতে থাকে দিনরাত।

নতুন শিশু জন্ম নিলে ঘনিষ্ঠজন ছাড়া কেউ সে বাড়িতে যেতে পারে না। ছেলে জন্ম নিলে ষষ্ঠ দিনে, মেয়ে হলে পঞ্চম দিনে নবজাতকের নামকরণ উত্সব পালন করা হয়। কেউ মারা গেলে তাকে গোর দেওয়া হয়। মৃতের আত্মার স্মরণে ভোজ দেওয়ার প্রথা চালু আছে। নাগরা খুব গণতান্ত্রিক। একটি গোত্রের মধ্যে কোনো শ্রেণিভেদ নেই, উঁচু-নিচু নেই। নাগারা খুব আমুদে এবং উত্সবপ্রিয়। বিচিত্র অলংকার, উজ্জ্বল ও রঙিন পোশাক পরা নাগাদের নৃত্য উত্সব দেখার মতো।

ভিনদেশিদের দেখে প্রথমে যারা সংশেয়ে ছিল পরে তারাই সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিল। প্রাথমিক কথাবার্তা শেষে নাগাদের ঐতিহ্যপূর্ণ পোশাকে ছবি তুলতে চাইলে সবেচেয় সুন্দরী কিশোরী মেয়েটিকে বলা হলো পোশাক পাল্টে আসতে। কারণ নারী-পুরুষ প্রায় সবার পরনে ছিল হাল আমলের প্যান্ট-শার্ট ও স্কার্ট-গাউন। মেয়েটি এল সাদা পোশাক পরে। গায়ে লাল-কালো ডোরা কাটা নাগা শাল জড়িয়ে। সঙ্গে মাল বহনের জন্য একটা শূন্য ঝুড়িও। একা ও সঙ্গে নাগা যুবককে নিয়ে ছবি তোলা হলো।

এরপর গোত্রপ্রধান সাহেব নিয়ে গেলেন তাঁর বাড়িতে, কাছেই। বসতে দিলেন কাঠের ড্রইংরুমে। বাহুল্যহীন আসবাব, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ঘর। কিন্তু ঘরে ঢোকার আগে পেরুতে হয় পাথুরে তোরণ। নানারকম চিহ্ন ও মূূর্তি আঁকা বিরাট কাঠের পাল্লা। গোত্রপ্রধান ইংরেজিতে সাবলীলভাবে কথা বললেও তাঁর হাসিখুশি স্ত্রী মাতৃভাষা ছাড়া অন্যকিছু জানেন না। তবে হাসিমুখে হাতে তুলে দিলেন সেদ্ধ ডিম, বিস্কুট ও চানাচুর। ইশারায় অনুরোধ করলেন সবটুকু শেষ করতে। শেষে নিয়ে এলেন ধোঁয়া ওঠা বড় কাপে চা।

 

৩.

গোত্রপ্রধানই সঙ্গে নিয়ে চললেন পাহাড়ের চূড়ায়। পাথরের খাড়া সিঁড়ি ভেঙে দম নিয়ে নিয়ে কমপক্ষে আট-দশতলা দালানের সমান উঁচু পাহাড়চূড়ায় উঠে পাওয়া গেল স্মৃতিস্তম্ভ। পাথরের ছোট বেদির ওপর তিন ফুট উঁচু পাথরের একটি পিলারের পাদদেশে ইংরেজিতে লেখা চার জনের নাম। ওপরে উঠতে সবাই হাঁফিয়ে গিয়েছি। পাথরের ওপর বসে রোদে পিঠ পেতে শুনলাম পুরনো দিনের গৌরবগাথা।

ব্যবসা করতে আসা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ইংরেজরা পলাশীর যুদ্ধে জিতে বণিকের দণ্ডকে শাসকের দণ্ডে পরিণত করে। ক্রমে ক্রমো শাসন এলাকা সম্প্রসারিত করতে থাকে। নৌযুদ্ধে বার্মাকে পরাজিত করে বার্মারাজার সঙ্গে ইয়ান্দবু সন্ধির (২৪ ফেব্রুয়ারি ১৮২৬) সূত্র ধরে ইংরেজরা আসাম, কাছার, জয়ন্তিয়া, মনিপুর তাদের অধিকারে আনে। এরপর তারা হাত বাড়ায় নাগাদের দিকে।

কোহিমা দখল করে ১৮৭৮ সালের নভেম্বর মাসে। এর আগের বছর ইংরেজরা মেজোমা গ্রাম দখল করে পুরো গ্রামটি পুড়িয়ে দেয়। খানোমা এবং মেজোমা এ দুটি গ্রাম ছিল সমৃদ্ধ এবং শক্তিশালী। গ্রাম দুটি থেকে প্রায়ই নাগাদের দল গিয়ে অতর্কিতে আক্রমণ করত পার্শ্ববর্তী ইংরেজ অধিকৃত এলাকায়। দু বছরে তারা লুট করে ছটি গ্রাম এবং হত্যা করে ৩৮৪ জনকে। যারা ছিল হয় ইংরেজ, নয়তো ইংরেজ অধিকৃত এলাকার বাসিন্দা। অবশ্য এ সময়ে অন্য ১৬টি নাগা গ্রাম ইংরেজদের বশ্যতা স্বীকার করে নেয়। কারণ আগ্রাসী ইংরেজদের সঙ্গে এসেছে মিশনারিরা। তারা চার্চ খুলে অশিক্ষিত আদিবাসীদের মধ্যে খ্রিস্টধর্ম প্রচারের সঙ্গে সেবা এবং শিক্ষা দেওয়ার কাজ শুরু করে উন্নত জীবনের স্বাদ-সুবিধা দেখাতে শুরু করেছে।

১৮৭৯ সালের ১৩ অক্টোবর ২১ জন সেপাই ৬৫ জন কনস্টেবল নিয়ে ডামান্ট যাত্রা শুরু করে খনোমা গ্রামের উদ্দেশে। অনেকেই তাকে খনোমা যেতে নিষেধ করেছিল। তার দোভাষি নাকি পায়ের কাছে নত হয়ে বারবার বাধা দিয়েছিল। কিন্তু সাহসী ইংরেজ নিবৃত্ত হয়নি। সে ভেবেছিল খনোমা গ্রাম শান্ত। গ্রামবাসীরা অনুগত। আগের মাসের জরিমানা দিয়েছে বিনা আপত্তিতে। দীর্ঘপথ অতিক্রম করে ডামান্ট পৌঁছায় খনোমা গ্রামের কাছে। চড়াই ভেঙে উঠে আসে গ্রামের প্রবেশে-তোড়নের সামনে। কাঠের বন্ধ পাল্লার সামনে দাঁড়াতেই বিপরীত দিক থেকে ছুটে আসা গুলিতে নিহত হয় ডামান্ট। খনোমা গ্রামবাসী তীরবেগে নেমে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ে ইংরেজ বাহিনীর ওপর। পুরো বাহিনী ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। মারা যায় ৩৫ জন, গুরুতর আহত হয় ১৯ জন।

দুঃসংবাদ সেদিনই কোহিমায় ইংরেজদের কাছে পৌঁছে যায়। তারা ২১ অক্টোবর অবরোধ করে খনোমা গ্রাম। অতি অল্প সময়ের মধ্যে এই অঞ্চলে ইংরেজদের তিনজন অফিসার নিহত হয়েছে। তারা ভাবল বিদ্রোহী নাগাদের শায়েস্তা করার জন্য এই উপযুক্ত সময়। সিলেট ও আসামে অবস্থিত লাইট ইনফ্যান্ট্রি ডিভিশনের সৈন্য, প্রচুর অস্ত্র ও গোলাবারুদ এবং দুটি ফিন্ড কামানসহ খনোমা গ্রাম আক্রমণ করা হয় ১৮৭৯ সালের ২২ নভেম্বর। গ্রামের বীর নাগারা রুখে দাঁড়ায়। মেজর কক, লেফটেন্যান্ট ফোবর্স, একজন নেটিভ সুবেদার মেজরসহ ইংরেজপক্ষে নিহত বা গুরুতরভাবে আহত হয় ৪৪ জন।

অসম যুদ্ধ দীর্ঘদিন চালিয়ে যাওয়া যাবে না বুঝে রাতের আঁধারে নাগা গ্রামবাসীরা পশ্চাদপসরণ করে। তারা কাছাকাছি পাহাড়ে আশ্রয় নিয়ে প্রতিশোধমূলক আক্রমণ চালিয়ে যেতে থাকে সুযোগ-সুবিধামতো। ইংরেজরা পরিত্যক্ত খনোমা গ্রাম এবং তাদের ধানচাষের জমি বাজেয়াপ্ত করে অন্য সম্প্রদায়ের নাগাদের মধ্যে বন্দোবস্ত দেওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু কেউই খনোমা গ্রামে জমি নিতে এগিয়ে আসে না। ইংরেজরা নমনীয় নীতি গ্রহণ করে। প্রায় দু বছর পরে শর্তাধীনে খনোমা গ্রামবাসী আত্মসমপর্ণ করে। গ্রামবাসীদের ওপর রাজস্ব ধার্য করা হয় বছরে বাড়ি প্রতি এক টাকা ও একমণ চাল।

১৫ আগস্ট ১৯৪৭ সালে ভারতের স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয়। ভারত সরকার সেনাবাহিনী প্রেরণ করে। নাগারাও অস্ত্র তুলে নেয়। কৌশল হিসেবে ভারত সরকার নাগাল্যান্ডে পুতুল সরকার গঠন করে। ১৯৬৩ সালের ১ ডিসেম্বর নাগাল্যান্ডকে ভারতের ১৬ নম্বর রাজ্য হিসেবে ঘোষণা করা হয়। সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড অব্যাহতই থাকে। সম্প্রতি এর অবসান হয়েছে। বিগত ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ সালে শান্তিপূর্ণভাবে বিধানসভার নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে। নাগারা তাদের অতীতদিনের স্মৃতিকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে। তাই ফেডারেল সরকারের স্মৃতিফলক সযতনে রক্ষা করছে প্রবেশ তোড়নের পাশে।

পাহাড়ের অনেক উঁচুতে ইংরেজরা খনোমা বিজয় এবং যুদ্ধে নিহত তাদের সৈন্যদের স্মরণে তৈরি করে স্মারক স্তম্ভ। এ জায়গাটা অনেক উঁচুতে, এখানে দাঁড়ালে চারদিকে অনেকদূর দেখা যায়। কাছে ও দূরে শুধুই পাহাড়। পাহাড়চূড়ার নিচে মেঘ ও কুয়াশা। অনেক নিচে সরু ফিতের মতো নদী, দেখা যায় কি যায় না। কোথাও কোনো শব্দ নেই। আমাদের কাছাকাছি  মেঘ, মনে হয় আমরা মেঘের মাঝেই রয়েছি। চারদিকে চেনা ব্যস্ত পৃথিবী উধাও। নাগাল্যান্ডের সবচেয়ে উঁচু পর্বতচূড়া সরামতি (১২,৫৫২ ফুট) এখান থেকে  অনেক দূরে। কিন্তু  আমাদের মনে হয় আমরা সরামতিরই কাছাকাছি রয়েছি।

এখান থেকে রাজধানী কোহিমাও দেখা যায়। আমরা সমতল ভূমির লোক, সিলেটের টিলা দেখেই সাধ মেটাই পাহাড় দেখার, আর এখন তো পাহাড়চূড়ায় মেঘের রাজ্যে দাঁড়িয়ে। দেখা আর শেষ হয় না, দাঁড়িয়েই থাকি। সামনে ইংরেজদের খনোমা যুদ্ধে নিহত সৈন্যদের স্মরণে তৈরি স্মারকস্তম্ভ। স্থানীয়রা প্রায় কেউই এখানে আসে না। বাইরে থেকে আাাসা গাইড বই পড়া পর্যটকরা খনোমা গ্রামে এসে শ্রদ্ধা জানায় গ্রামবাসীদের তৈরি এই নিরাভরণ স্মারকস্তম্ভে। আমাদের সঙ্গে ফুল ছিল, আমরাও ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানিয়ে নিচে নেমে এলাম।

দরজার মুখে দাঁড়িয়েছিলেন গোত্রপ্রধান সাহেবের স্ত্রী মিসেস দোজো খোটে। জুটিবদ্ধ তাঁদের ছবি তুলতে চাইলে খুশি মনেই সম্মতি জানালেন। ভদ্রমহিলা চট করে পোশাক পাল্টালেন। মি. দোজো ছিলেন সাদা শার্ট নেভি ব্লু ফুলপ্যান্টে ইন করে। তেমনিভাবে ক্যামেরার সামনে দাঁড়ালে স্ত্রী আবার দৌড়ে ঘরে যেয়ে ভাঁজ করা লাল-কালো-সাদার ডোরাকাটা শাল এনে স্বামীর কাঁধে ঝুলিয়ে দিলেন। এই শাল নাগাদের কমন ড্রেস। ভিউ ফাইন্ডারে চোখ রেখে শাটার টিপতে দেরি করছি দেখে মিসেস দোজো স্বামীকে বাহুতে খোঁচা দিয়ে জানতে চাইলেন কী হয়েছে। মি. দোজো আমাদের জিজ্ঞেস করলেন, এনি থিং রঙ?

বললাম, না, ভিউ ফাইন্ডারে আমি দেখছিলাম পৃথিবীর এক সুখী দম্পতিকে। মি. দোজো তা স্ত্রীকে জানালে তাঁর স্ত্রীর সারামুখে যে হাসি খেলল তা দেখে বুঝতে একটুও অসুবিধা হয় না যে পৃথিবীর সব ভালো আর সুখী মানুষেরা এমনই হয়।

ফিরে আসার সময় গ্রামবাসী সমবেতভাবে বিদায় জানাল করমর্দন, আলিঙ্গন ও হাত নেড়ে। শহর থেকে খনোমা আসার সময় আমরা কেউই ভাবতে পারিনি যে একটি অচেনা ও ভিনদেশি গ্রামকে, গ্রামের মানুষজনকে এত ভালো লাগবে।

কিন্তু তখনো জানতাম না যে ভালো লাগার সঙ্গে অলক্ষে জড়িয়ে থাকে কিছু বিষাদও। দেশে ফিরে আসার সময় সীমান্তের ভারতীয় কাস্টমস ছবির সব নেগেটিভ রেখে দেয়। ছবি হারাবার কষ্টের চেয়ে বেশি কষ্ট পাই গ্রামাবাসীদের যে কথা দিয়ে এসেছিলাম দেশে ফিরে আমার তোলা সব ছবির কপি পাঠাব তা আর হলো না। এখনো চোখের সামনে ভাসে ফিরে আসার দৃশ্যের কথা। বুনো ফার্ন ও অর্কিড, নাম না জানা অজস্র তরুলতা ও বৃক্ষে ছাওয়া পাহাড়ি পথ, ঝরনার পানি মাড়িয়ে দিলীপ থাপার ট্যাক্সি ঘুরে ঘুরে ভাঙছে কোহিমার চড়াই উতরাই পথ, বিপরীত দিকের পাহাড় থেকে দেখা যাচ্ছে উঁচু পাহাড়ের ঢালে খনোমা গ্রামের বাড়ি-ঘর, যেন গ্রামের লোকেরা এখনো পাথরের তোড়নের কাছে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে রয়েছে আমাদের বিদায়ের দিকে। আবার বিষাদের ভেতর আনন্দও লাগে এই ভেবে, বিদায়ের শেষ সময়ে দোজো পরিবারকে যা বলেছি, তোমাদের দেশে আর কখনো হয়তো আসা হবে না, কিন্তু আমাদের সবসময় মনে থাকবে বিশাল পৃথিবীর এই দূরদেশে আমাদের একঘর স্বজন রয়েছে।

 

 

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন