শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

ডেঙ্গু পরিস্থিতি

বাড়ছে আক্রান্তের সংখ্যা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার উদ্বেগ

আপডেট : ২০ জুলাই ২০১৯, ২১:৪৪

ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছেই। চলতি মাস শেষ হতে ১০ দিন বাকি। ইতিমধ্যে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তির গত মাসের রেকর্ড ভেঙেছে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার অ্যান্ড কন্ট্রোল রুম থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী  ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে জুনে হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা ছিল ১৭৭০ জন। আর জুলাইয়ের ২০ দিনেই ভর্তি হয়েছে ৩৯৬০ ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত রোগী। তাদের মধ্যে এখনো চিকিত্সাধীন রয়েছেন ১৪৭৪ রোগী। ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্তের সংখ্যা বৃদ্ধিতে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। তবে আক্রান্তের হার বাড়লেও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আছে বলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা মনে করছে। বিশেষজ্ঞ চিকিত্সকরা বলেন, ডেঙ্গু জ্বর নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। তবে জ্বর কমলেও রোগীকে রাখতে হবে পর্যবেক্ষণে। 

ব্যাংককের বামরুদগ্রান্ড হাসপাতাল ও ব্যাংকক জেনারেল হাসপাতালের চিকিত্সকরা জানান, ডেঙ্গু জ্বর নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। ব্যাংককে সাধারণ জ্বরের মতো ডেঙ্গু জ্বর অহরহ হচ্ছে। তবে ডেঙ্গু জ্বর হলে সঠিক ব্যবস্থাপনায় সুচিকিত্সা নিতে হবে। বাংলাদেশের চিকিত্সকদের সেই চিকিত্সা সেবা দেওয়ার সক্ষমতা ও ব্যবস্থা আছে। বাংলাদেশের চিকিত্সকরা এ ব্যাপারে অভিজ্ঞ।

এদিকে গতকাল শনিবার রাজধানীতে ২৩৩ জন ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে গত ২৪ ঘণ্টায় ১১১ জন ডেঙ্গু জ্বরে আক্রন্ত হয়ে চিকিত্সা নিয়েছেন। রক্ত পরীক্ষার জন্য এ হাসপাতালে দেখা গেছে দীর্ঘ লাইন। এ পর্যন্ত এ হাসপাতালে চিকিত্সাধীন রয়েছেন ৩৬৯ জন।

ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ কে এম নাসির উদ্দিন বলেন, এ হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগীর সুচিকিত্সার সব ধরনের ব্যবস্থা আছে। তবে গুরুতর অবস্থায় আসায় দুইজন রোগীর মৃত্যু হয়েছে। 

ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক ডা. মজিবুর রহমান বলেন, এখন প্রচুর ডেঙ্গু রোগী আসছে। আমরা চিকিত্সা সেবা দিচ্ছি। ডাক্তার-নার্সদের এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেওয়া আছে।

ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ক্লিনিক্যাল প্যাথলজি বিভাগের প্রধান ডা. আজিজ আহমেদ খান বলেন, হাসপাতালে রক্ত পরীক্ষা করতে আসা রোগীদের ৫০ ভাগই ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন অনুষদের সাবেক ডিন, বিশিষ্ট মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ বলেন, ডেঙ্গু জ্বর কমে গেলেও চিকিত্সকের পর্যবেক্ষণে থাকতে হবে। কারণ দুই-তিন দিনের মধ্যে রক্তের প্লাল্টিলেট কমে হেমোরেজিকের ঝুঁকি বেড়ে যাচ্ছে। জ্বর কমে যাওয়ার পরবর্তী সময়টাকে তাই বলা হয় ‘ক্রিটিক্যাল পিরিয়ড’। এ সময় সচেতন থাকা এবং চিকিত্সকের পরামর্শ অত্যন্ত জরুরি।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইরোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. সাইফুল্লা মুন্সি বলেন, দেড় মাস যাবত্ প্রচুর রোগী পরীক্ষা করতে এসেছে। আগত রোগীদের ৫০ ভাগই ডেঙ্গুতে আক্রান্ত।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (চিকিত্সা শিক্ষা ও জনশক্তি উন্নয়ন) অধ্যাপক ডা. নামজুল হক বলেন, এ বছর ডেঙ্গু রোগী বাড়ছে। আমরা ব্যবস্থা নিচ্ছি। তবে ডেঙ্গু জ্বর থেকে বাঁচতে অ্যাডিস মশা নির্মূল করতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। একই সঙ্গে সচেতনতা বাড়ানোর ওপর গুরুত্বারোপ করেন তিনি।

ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণসমূহ

ডেঙ্গু প্রধানত দুই ধরনের হয়ে থাকে, ক্লাসিক্যাল ডেঙ্গু ফিভার এবং ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার। ক্লাসিক্যাল ডেঙ্গু জ্বরে সাধারণত তীব্র জ্বর ও সেই সঙ্গে সারা শরীরে প্রচ্ল ব্যথা হয়ে থাকে। জ্বর ১০৫ ফারেনহাইট পর্যন্ত হয়ে থাকে। শরীরে বিশেষ করে হাড়, কোমর, পিঠসহ অস্থিসন্ধি এবং মাংসপেশীতে তীব্র ব্যথা হয়। এছাড়া মাথাব্যথা ও চোখের পিছনে ব্যথা হয়। অনেক সময় ব্যথা এত তীব্র হয় রোগী মনে করে বুঝি হাড় ভেঙে যাচ্ছে। তাই এই জ্বরের আরেক নাম ‘ব্রেক বোন ফিভার’। জ্বর হওয়ার ৪ বা ৫ দিনের সময় সারা শরীরজুড়ে লালচে দানা দেখা যায়, যাকে বলা হয় স্কিন র্যাশ, অনেকটা এলার্জি বা ঘামাচির মতো। এর সঙ্গে বমি বমি ভাব, এমনকি বমি হতে পারে। রোগী অতিরিক্ত ক্লান্তিবোধ করে এবং রুচি কমে যায়। সাধারণত ৪ বা ৫ দিন জ্বর থাকার পর তা এমনিতেই চলে যায় এবং কোনো কোানো রোগীর ক্ষেত্রে এর ২ বা ৩ দিন পর আবার জ্বর আসে। একে ‘বাই ফেজিক ফিভার’ বলে।

ডেঙ্গু হেমোরেজিক জ্বর

এই অবস্থাটাই সবচেয়ে জটিল। এই জ্বরে ক্লাসিক্যাল ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণ ও উপসর্গের পাশাপাশি আরো যে সমস্যাগুলো হয়, তা হলো- শরীরের বিভিন্ন অংশ থেকে রক্ত পড়া শুরু হয়। যেমন: চামড়ার নিচে, নাক ও মুখ দিয়ে, মাড়ি ও দাঁত হতে, কফের সঙ্গে, রক্তবমি, পায়খানার সাথে তাজা রক্ত বা কালো পায়খানা, চোখের মধ্যে এবং চোখের বাইরে, মহিলাদের বেলায় অসময়ে ঋতুস্রাব অথবা রক্তক্ষরণ শুরু হলে অনেকদিন পর্যন্ত রক্ত পড়তে থাকা ইত্যাদি। এই রোগের বেলায় অনেক সময় বুকে পানি, পেটে পানি ইত্যাদি দেখা দিতে পারে। অনেক সময় লিভার আক্রান্ত হয়ে রোগীর জন্ডিস, কিডনিতে আক্রান্ত হয়ে রেনাল ফেইলিউর ইত্যাদি জটিলতা দেখা দিতে পারে।

 রোগী কখন ডাক্তার দেখাবে

চিকিত্সকরা বলেন, ডেঙ্গু জ্বর নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই।  কোনো অবস্থাতেই অ্যান্টিবায়োটিক বা এসপিরিন জাতীয় ওষুধ খাওয়া যাবে না। শরীরের যে কোনো অংশ থেকে রক্তপাত হলে, প্লাটিলেটের মাত্রা কমে গেলে, শ্বাসকষ্ট হলে বা পেট ফুলে পানি আসলে, প্রস্রাবের পরিমাণ কমে গেলে, জন্ডিস দেখা দিলে, অতিরিক্ত ক্লান্তি বা দুর্বলতা দেখা দিলে, প্রচন্ড পেটে ব্যথা বা বমি হলে সঙ্গে সঙ্গে ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।

গতকাল বনানীতে ডিএসসিসি মেয়র সাঈদ খোকনের বাসভবনে বৈঠক করেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার একটি প্রতিনিধি দল। পাঁচ সদস্যের প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেন বাংলাদেশে ডব্লিউএইচও’র ভারপ্রাপ্ত প্রতিনিধি ড. এডউইন স্যানিজা স্যালভেদর। বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের ড. এডউইন বলেন, ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আমরা সিটি করপোরেশন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এবং অন্যান্য সরকারি সংস্থাগুলোর সঙ্গে কাজ করতে চাই। তারই অংশ হিসেবে মেয়রের সঙ্গে বৈঠক করেছি আমরা। তিনি এ নিয়ে আতঙ্কিত না হওয়ার পরামর্শ দেন।

মেয়র সাঈদ খোকন বলেন, বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থাকে আমরা সুনির্দিষ্ট কিছু পয়েন্ট দিয়েছি। যেমন আমাদের ওষুধ কার্যকর কিনা তারা পরীক্ষা করে দেখবে, ওষুধ পরিবর্তন দরকার কিনা, দরকার হলে তা কেমন হবে কিংবা নতুন ওষুধ দরকার কিনা তা পরীক্ষা করে দ্রুত জানাবে। ডেঙ্গু পরিস্থিতি এখনও নিয়ন্ত্রণে আছে জানিয়ে তিনি বলেন, বিগত কয়েক বছরের তুলনায় এবার ডেঙ্গুর প্রকোপ অনেক বেশি। তবুও আমাদের আশেপাশের অনেক দেশের তুলনায় আমরা ভালো অবস্থানে আছি।