বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

পর্যটনশিল্প নিয়ে ভাবতে হবে

আপডেট : ০১ জুলাই ২০১৯, ২১:৩৬

শাহেদ জাফর

অজানাকে জানার এবং অদেখাকে দেখার প্রবৃত্তি মানুষের চিরন্তন—এই ধারণা থেকেই পর্যটনের উদ্ভব। পার্শ্ববর্তী দেশ নেপালের জাতীয় আয়ের ৬২ ভাগ আসে পর্যটন খাত থেকে। মালদ্বীপের জাতীয় আয়ের সিংহভাগ আসে ট্যুরিজম খাত থেকে। এশিয়ানভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া পর্যটনশিল্পে অনেক এগিয়ে গেছে।

আমাদের দেশে বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘ সমুদ্রসৈকত কক্সজার রয়েছে, পৃথিবীর সবচেয়ে বড়ো ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন রয়েছে, রয়েছে কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকত যেখান থেকে সূর্যোদয় এবং সূর্যাস্ত দুটোই দেখা যায়। সেন্ট মার্টিন, রামুর বৌদ্ধ মন্দির, হিমছড়ির ঝরনা, ইনানী সমুদ্রসৈকত, বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্ক, হাতিয়ার নিঝুম দ্বীপ, টাঙ্গুয়ার হাওর, টেকনাফ সহজেই পর্যটকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। পার্বত্য চট্টগ্রামের সবুজ পাহাড়ি অঞ্চল দেখে কেউ কেউ আত্মভোলা হয়ে যায়। আবার আমাদের দেশে অনেক ঐতিহাসিক এবং প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানও রয়েছে। বগুড়ার মহাস্থানগড়, নওগাঁর পাহাড়পুর, দিনাজপুরের কান্তজীর মন্দির, ঢাকার লালবাগ কেল্লা, আহসান মঞ্জিল, বাগেরহাটের ষাটগম্বুজ মসজিদ, খান জাহান আলীর মাজার, রাজশাহীর বরেন্দ্র জাদুঘর, কুষ্টিয়ার লালন শাহের মাজার, রবীন্দ্রনাথের পুঠিবাড়ি শুধু দেশীয় নয় বরং বিদেশি পর্যটক ও দর্শনার্থীদের নিকটও সমান জনপ্রিয় এবং সমাদৃত। বর্তমানে বিশ্বব্যাপী পর্যটকের সংখ্যা প্রায় ১০০ কোটি, ধরা হচ্ছে ২০২০ সাল নাগাদ এ সংখ্যা দাঁড়াবে প্রায় ২০০ কোটি। পর্যটন বিশেষজ্ঞদের মতে, এই বিপুলসংখ্যক পর্যটকের প্রায় ৮৩ শতাংশ ভ্রমণ করবেন এশিয়ার দেশগুলোতে। এছাড়াও বিশ্ব পর্যটন সংস্থার তথ্যমতে, ২০১৮ সালের মধ্যে এ শিল্প থেকে ২৯ কোটি ৭০ লাখ লোকের কর্মসংস্থান হবে, যা বিশ্ব অর্থনীতিতে অবদান রাখবে ১০.৫ ভাগ। বাংলাদেশ যদি এ বিশাল বাজার ধরতে পারে, তাহলে পর্যটনের হাত ধরেই বদলে যেতে পারে বাংলাদেশের অর্থনীতি। স্বাভাবিকভাবে বাংলাদেশের পর্যটনশিল্প উন্নয়নের সম্ভাবনা অপরিসীম। পর্যটনশিল্পের সবটুকু সম্ভাবনা কাজে লাগাতে পারলে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে মডেল হতে পারে।

আমাদের পর্যটনশিল্প বিকাশের যথেষ্ট সম্ভাবনা থাকলেও পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর তুলনায় আমরা ক্রমাগত পিছিয়ে পড়ছি। আমাদের পার্শ্ববর্তী অনেক দেশ, যেখানে এই শিল্পের ওপর নির্ভর করে অর্থনীতি এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, সেখানে আমরা স্থবির হয়ে আছি। সিঙ্গাপুরের জাতীয় আয়ের ৭৫ শতাংশ, তাইওয়ানের ৬৫ শতাংশ, হংকংয়ের ৫৫ শতাংশ, ফিলিপাইনের ৫০ শতাংশ, থাইল্যান্ডের ৩০ শতাংশ আসে পর্যটন খাত থেকে। মালদ্বীপের অর্থনীতির বেশিরভাগই আসে পর্যটন খাত থেকে। এছাড়া মালয়েশিয়ার বার্ষিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ৭ শতাংশই আসে পর্যটন খাত থেকে। অথচ ওয়ার্ল্ড ট্রেড অ্যান্ড ট্যুরিজম করপোরেশনের তথ্যমতে, ২০০৯ সালে বাংলাদেশের জিডিপিতে পর্যটন খাতের অবদান ছিল মাত্র ৩.৯ ভাগ। ২০২০ সাল নাগাদ এর পরিমাণ বেড়ে ৪.১ ভাগ হবে বলে তারা আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন।

পর্যটনশিল্পে অনেক সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশ আশানুরূপভাবে অগ্রগতি করতে পারছে না। সকল সমস্যা চিহ্নিত করে জরুরি ভিত্তিতে সমাধান করে পর্যটনশিল্পকে বিকশিত করা প্রয়োজন। তবেই বাংলাদেশের অপরিসীম সম্ভাবনাময় পর্যটনশিল্প দেশের অর্থনীতিতে আশানুরূপ ভূমিকা রাখতে পারবে।

ভৌগোলিক অবস্থান এবং প্রাকৃতিক পরিবেশ বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পের জন্য অত্যন্ত অনুকুল। তাই এ শিল্প খাতটিতে সরকারি ও বেসরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধি করা একান্ত প্রয়োজন, যাতে পর্যটন কেন্দ্রগুলোর আধুনিকায়ন, অবকাঠামোগত উন্নয়ন এবং পর্যাপ্ত বিনোদন ব্যবস্থা চালু করা যায়। পর্যটনশিল্পের জন্য উচ্চপর্যায়ে একটি বোর্ড গঠন করার মাধ্যমে এ শিল্পে তদারকি বৃদ্ধি করা একান্ত প্রয়োজন। এজন্য সরকারকেই উদ্যোগ নিতে হবে। পর্যটনকে বলা হয় ‘অদৃশ্য রপ্তানি পণ্য’। এই অদৃশ্য পণ্যকে কাজে লাগিয়ে বিশ্বের অনেক দেশ অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটিয়েছে। অথচ অফুরন্ত সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও এ ক্ষেত্রে আমরা পিছিয়ে আছি। সপ্তম শতকে চৈনিক পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙ বাংলাদেশ ভ্রমণে এসে উচ্ছ্বসিত হয়ে বলেছিলেন :‘A sleeping beauty emerging from mists and water.’ এই উচ্ছ্বসিত প্রশংসাকে সর্বদা ধরে রাখার মাধ্যমে পর্যটনশিল্পের বিকাশের দায়িত্ব আমাদের।

n লেখক :শিক্ষার্থী, টিচার্স ট্রেনিং কলেজ, রাজশাহী