বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

ঘটকশালা

আপডেট : ৩০ মার্চ ২০১৯, ১৯:২২

g  জামসেদুর রহমান সজীব

 

এক শ একটা বিজনেস পরিকল্পনার পিণ্ডি চটকিয়ে আবুল বেপারি ‘ঘটকশালা’ খুললেন। এটি মূলত একটি ঘটকালি অ্যাজেন্সি। সদ্য বুয়েট পাস করা শালাকে নিয়ে শুরু করলেন প্রতিষ্ঠানটি। তার শালা আই মিন শ্যালক হিমেলও দেখল চাকরির বাজার খুব মন্দা, দুলাভাইয়ের লেজ ধরে আপাতত লেগে থাকা যেতেই পারে। খুব হিসাবনিকাশ করে দুলাভাইকে প্রতিষ্ঠানের নামকরণের ইতিহাস বিষয়ে গাম্ভীর্য আনতে বুঝাল, ‘পাঠশালা, পানশালার মতো এটিও একটি জনসেবামূলক ও লাভজনক প্রতিষ্ঠান হিসেবে গণ্য হবে। সমাজের উপকারে আসবে।’ অথচ এরপরও কেউ নামকরণের ইতিহাস জানতে চাইলে আবুল বেপারি দন্তপাটি বের করে সহজ-সরলভাবে বলেন, ‘আমি ঘটক, সঙ্গে আছে শালা। তাই প্রতিষ্ঠানের নাম দিয়েছি ঘটকশালা!’

কাজকামে চালু না হলেও আবুল বেপারি বহুদিন ধরেই একটা ব্যবসা চালু করার পায়তারা করছিলেন। প্রথমদিকে এলাকায় একটা রেস্টুরেন্ট খোলার পরিকল্পনা করেছিলেন। তখন হঠাত্ অনিরাপদ গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে দেশে। বউ টানা কয়েকদিন কেঁদেকেটে একাকার। রান্নাবান্না সব বন্ধ। স্বামীকে এমন ব্যবসায় জড়াতে দেবেই না। আবুল পড়লেন বিপদে। বাসায় রান্না হয় না। গ্যাস সিলিন্ডারের ভয়ে কোনো হোটেল বা রেস্টুরেন্টে খেতেও যেতে পারেন না। রেস্টুরেন্ট ব্যবসার পরিকল্পনা বাদ দিতে হলো। এরপর চিন্তা করলেন, ট্রান্সপোর্ট ব্যবসায় অংশীদার হবেন। বন্ধুবান্ধবকে রাজি করিয়ে ব্যবসা দাঁড় করাতে যাবেন এমন সময় দেশে তোলপাড় লাগল। বাস-ট্রাক যেখানে সেখানে মানুষচাপা দিচ্ছে। বউ এবারও কেঁদেকেটে একাকার। রান্নাবান্না বন্ধ। এ ব্যবসায় জড়ানো যাবে না। কেবল দুবেলা খেয়েপরে বেঁচে থাকার তাগিদে এ পরিকল্পনাও বাদ দিতে হলো। বুঝতে পারলেন এমন কিছু চিন্তা করতে হবে যাতে বউ অন্তত রান্নাবান্না বন্ধ না করে। কিন্তু কোনোক্রমেই ব্যাটে-বলে মিল ছিল না। এরপর হুট করেই তার নজরে আসে সদ্য বিবাহিত ক্রিকেটার মিরাজ ও মুস্তাফিজের বিয়ের খবর। অগ্নিকাণ্ড, সড়ক দুর্ঘটনা, খুন-ধর্ষণের চাইতেও খুব ঘটা করে তাদের বিয়ের খবর ছড়িয়ে পড়ল চারপাশে। আবুল বেপারির চোখ চকচক করে ওঠে। মনে মনে বলেন, ‘আমি পাইলাম। অবশেষে ইহাকে পাইলাম।’ শেষমেশ ক্রিকেটারদের বিয়ের ঘটনা থেকে অনুপ্রাণিত হয়েই প্রতিষ্ঠানটি খুলে ফেললেন আবুল।

খরচাপাতি করে ধুমধামের মধ্য দিয়ে ঘটকশালা খোলা হলেও ধীরে ধীরে শালা-দুলাভাই বুঝলেন এ পথ অতটা সোজা না। বিয়ের জন্য ঘটকালির প্রয়োজনীয়তা থাকলেও ঘটকালির প্রতিষ্ঠান একটু বাড়াবাড়িই বৈকি। এখন ঘরে ঘরে ঘটক পাওয়া যায়। পরিবারের মুরব্বিরাই ঘটকালি করে থাকেন। বিষয়টা নিয়ে খুব বিপাকে আবুল ও তার শালা হিমেল। এরা দুজন লুঙ্গিতে কাছা মেরে নেমে পড়লেন প্রতিষ্ঠানের প্রচারণায়। প্রথমে স্ট্যাডি করতে থাকলেন—এ লাইনে তাদের সঙ্গে কারা কারা কম্পিটিশন করতে পারে। কিন্তু স্ট্যাডি করতে গিয়ে যা বেরিয়ে এলো, তা হলো তাদের কম্পিটিশন কেবলমাত্র একজনের সঙ্গেই। আর সে নান-আদার-দ্যান মার্ক জুকারবার্গ। নাম উচ্চারণে কষ্ট হওয়ায় আবুল জিজ্ঞেস করেই বসে, ‘এই জোকার ক্যাডা?’ তার শালাবাবু হিমেল মাথা চুলকিয়ে জানায়, ‘ফেসবুকের প্রতিষ্ঠাতা হলো এই মামুর বেটা।’ ভিনদেশে থাকা লোকটা কী করে তাদের প্রতিযোগী হলো এ ব্যাপারে জানাল, এখন ছেলেমেয়ের ফেসবুকেই পরিচয় হয়। কে কেমন দেখতে, কী ফিল করে, কী খায়, কই কই যায় সব জানা যায় ফেসবুকে। কষ্ট করে মুরব্বিদেরও খোঁজখবর নেওয়া লাগে না। আর ঘটকালির জন্য ঘটক খোঁজার তো প্রশ্নই আসে না।

আশাহত মন নিয়েই অপেক্ষার প্রহর গুনতে থাকে শালা-দুলাভাই। ব্যবসা যেহেতু শুরু করেছে, মাঝপথে ছেড়ে তো আর দেওয়া যায় না। দিন যায়, সপ্তাহ যায়, মাস যায়। তারপর একদিন মেঘ না চাইতেই জল আসার মতো এক কাস্টমার এসে উদয় হয় তাদের অফিসে। মধ্য বয়স্ক চাকরিজীবী এক হূদয়ভাঙা ব্যক্তি হূদয় জোড়া লাগাতে তাদের শরণাপন্ন হন। প্রতিষ্ঠানের প্রথম কাস্টমার পেয়ে আবুল খুশিতে আত্মহারা হয়ে যান। আবেগের ঠ্যালায়, খুশিতে ঘুরতে ঘুরতে বাসায় গিয়ে বউকে দিয়ে ভালো-মন্দ রান্না করিয়ে সেগুলো এনে কাস্টমারকে খাওয়ান। খাতির-অ্যাপায়ন পর্ব শেষ করে লোকটাকে জিজ্ঞেস করেন, ‘আপনার কী ধরনের পাত্রী লাগবে? ফর্সা, শ্যামলা, কালা, লম্বা, খাটো, মোটা, চিকন, চারকোণা, শিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত, অশিক্ষিত, রূপবতী, গুণবতী, গর্ভবতী, সাবালিকা, নাবালিকা, ডিভোর্সি... যেমন চাইবেন তেমনই পাইবেন!’ আবুলের কথা শেষ হওয়ার পরেও লোকটার ঘোর কাটে না। কিছুক্ষণ খিঁচ মেরে বসে থাকার পর বলে ওঠেন, ‘আমি প্রেমে ছ্যাঁকা খেয়েছি। আমি এমন মেয়েকে বিয়ে করব যে নিজেও প্রেমে ছ্যাঁকা খেয়েছে। বর্তমানে একাকী আছে।’ লোকের কথা শুনে শালা-দুলাভাইয়ের হাসিমুখ পাল্টে যায়। আরে বলে কী লোকটা, গর্দভ নাকি! এই সমাজে এমন মেয়ে আছে নাকি যে স্বীকার করবে সে প্রেমে ছ্যাঁকা খেয়েছে! নারী মাত্রই ছ্যাঁকা দেয়, তারা ছ্যাঁকা খাওয়ার পাত্রী না। হিমেল হিসাব কষে, শতকরা ১ ভাগ নারী থাকলেও থাকতে পারে যারা প্রেমে ছ্যাঁকা দেওয়ার স্থলে ছ্যাঁকা খেয়ে বসে থাকে। কিন্তু সেই শতকরা ১ ভাগ নারীও এটা অস্বীকার করে যে তারা জীবনে প্রেমে করেছে। ঘণ্টাখানেক ধরে শালা-দুলাভাই একে-অপরের চুল ছিঁড়েও কোনো কূল-কিনারা না পেয়ে তাদের প্রথম কাস্টমারকে দরজা দেখিয়ে বিদায় জানাল। লোকটা চলে যাওয়ার পর আবুল বেপারি তার শালাকে বিরস বদনে বললেন, ‘বাদ দে শালা। চল নতুন ব্যবসার খোঁজ করি। দেশে কামকাজের অভাব নাই।’

অবশেষে তারা দুজন সফলভাবে এই ব্যর্থ প্রতিষ্ঠানের ইতি টানলেন।   g

 

 

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন