বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

উপমহাদেশে হাদিস চর্চা ও দীনের প্রচার

আপডেট : ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ১৯:৪৬

মহাগ্রন্থ আল-কুরআনের মতো হাদিসে রাসুলও (স) আল্লাহর ওহী বা প্রত্যাদেশ হিসেবে স্বীকৃত ও প্রমাণিত। যেমন কুরআন করীমের ভাষায়-‘এবং প্রবৃত্তির তাড়নায় কথা বলেন না। যা ওহী ছাড়া আর কিছু নয়, যা প্রত্যাদেশ হয়’ (সূরা আল-নাজম:৪-৫)।  পার্থক্য শুধু এতটুকু মহাগ্রন্থ আল-কুরআনের ভাব ও ভাষা দুটিই আল্লাহর। আর হাদিসে রাসুলের (স) ভাব আল্লাহর তবে যা প্রত্যাদেশ হয়েছে মহানবী (স) স্বীয় কথা, কর্ম ও সম্মতির মাধ্যমে। তাই হাদিসে রাসুলের (স) গুরুত্ব কোনোভাবেই কম নয়।

একদল বিচক্ষণ ও দক্ষ আসহাবে রাসুল সর্বদা হাদিসে রসুল সংগ্রহ ও সংরক্ষণে স্বউদ্যোগে সরাসরি নিয়োজিত ছিলেন। তাঁরা মহাগ্রন্থ আল-কুরআনের সংরক্ষণে যেমন যত্নবান ছিলেন অনুরূপভাবে হাদিসে রসুল সংরক্ষণেও একনিষ্ঠ ছিলেন এবং বিচক্ষণতার সঙ্গে তা সংরক্ষণ করেছিলেন বিধায় প্রাথমিক যুগে রাসুল (স) নিজে সাধারণভাবে বারণ করলেও বিশেষভাবে কয়েকজন আসহাবে রাসুলকে তা সংরক্ষণে মৌন সম্মতি দিয়েছিলেন বলে সঠিক ইতিহাসের আলোকে প্রমাণিত। বিশেষ করে যারা ঘর-বাড়ি ছেড়ে সার্বক্ষণিক রাসুলের (স) দরবারে পড়ে থাকতেন এবং হাদিসে রাসুল সংরক্ষণে নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত ছিলেন তাঁরা ইতিহাসের পাতায় আসহাবে সুফ্ফা হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছেন। তাঁদের মধ্যে হযরত আবু হুরায়রা ৫৩৬৪টি  হাদিস বর্ণনা করে শীর্ষে অবস্থান করছেন।

হিজরি প্রথম শতকের শেষ দিকে মুহাম্মদ বিন কাসিমের অভিযানের পরবর্তী সময়ে ভারতীয় উপমহাদেশে হাদিস চর্চা ও হাদিসের শিক্ষা প্রদান শুরু হলে বেশ ক’জন আরব হাদিস বিশারদ হাদিস শিক্ষা প্রদানের লক্ষ্যে ভারতীয় উপমহাদেশে আগমন করে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। পরবর্তী পর্যায়ে তাঁদেরকে কেন্দ্র করে উক্ত অঞ্চলে বেশকিছু হাদিস চর্চা ও শিক্ষাকেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হয়। তাঁদের মধ্যে মুসা ইব্ন ইয়াকুব আল-সাকাফী, ইয়াযিদ বিন আবি কাবশা আল-দিমস্কী, আল-মুফাদ্দাল ইব্ন মুহাল্লাব ও আবু মুসা ইসরাঈল আল-বসরী প্রমুখ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

পরবর্তী পর্যায়ে হিজরি ৫ম শতাব্দী থেকে হিজরি ৮ম শতাব্দীর শেষ পর্যন্ত ভারতীয় উপমহাদেশে হাদিস চর্চা ও হাদিসের শিক্ষা প্রদান ব্যাপকভাবে বিস্তৃতি লাভ করে। বিশেষ করে সুলতান মাহমুদ গযনবীর পাঞ্জাব অভিযানের পরবর্তী সময়ে লাহোর হাদিস চর্চা ও হাদিসের শিক্ষা প্রদানের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়। পরে সিন্ধু, গুজরাট, দিল্লি­সহ ভারতীয় উপমহাদেশের সব কটি বড় শহরে হাদিস চর্চা ও হাদিসের শিক্ষা অধিকহারে বিস্তৃতি লাভ করে। উল্লেখ্য, গুজরাটের প্রথম আমীর আহমদ শাহ কর্তৃক ভারত ও আরবের মধ্যে সামুদ্রিক যোগাযোগ স্থাপিত হলে দুই অঞ্চলের জনগণের মধ্যে সরাসরি সম্পর্ক তৈরি হয় এবং ভারতীয় উপমহাদেশের শিক্ষার্থীদের হাদিস চর্চা ও হাদিসের শিক্ষা গ্রহণের উদ্দেশ্যে আরব দেশে গিয়ে সরাসরি আরবদের নিকট হাদিসের শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ সৃষ্টি হলে অনেকে মক্কা, মদীনা, মিশর ও বাগদাদসহ বিভিন্ন আরব অঞ্চলে গিয়ে হাফেজ ইব্ন হাজর আসকালানী, ইমাম সাখাবী, ইব্ন হাজর হায়সামী মক্কী প্রমুখের নিকট হাদিসের শিক্ষা গ্রহণ করে দেশে ফিরে স্বউদ্যোগে হাদিসের শিক্ষা প্রদানে নিয়োজিত হন। তাঁদের মধ্যে মাওলানা নুরুদ্দিন সিরাজী, হাফেজ রুকনুদ্দিন কুরাইশী, শায়খ বদরুদ্দিন মুহাম্মদ ইব্ন আবু বকর ইস্কান্দরী, ইয়াহইয়া ইব্ন আবদুর রহমান হাশেমী, হোসাইন ইব্ন মঈজুদ্দিন বিহারী, কাজী শিহাবুদ্দিন দৌলতপুরী, জালালুদ্দিন দাওয়ানী, মাওলানা আবদুল আযীয ইব্ন মুহাম্মদ তুসী, হোসাইন ইব্ন আবদুল্লাহ কিরমানী, সৈয়দ রফীউদ্দিন, মীর সৈয়দ আবদুল আওয়াল জৌনপুরী, শায়খ আবদুল মালেক গুজরাটী ও শায়খ ইয়াকুব কাশ্মীরী প্রমুখ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এসকল মহান ব্যক্তির পর হিজরি একাদশ শতাব্দীতে ভারতীয় উপমহাদেশে হাদিস চর্চা ও হাদিসের শিক্ষার নবজাগরণ সৃষ্টি হয়। এই মহান কাজে শীর্ষে ছিলেন বিশিষ্ট সমাজ সংস্কারক শায়খ আহমদ সরহিন্দি (মুজাদ্দিদে আলেফ সানী) ও আবদুল হক মুহাদ্দিসে দেহলবী।

বাংলার সুলতান আলাউদ্দিন হোসাইন শাহ ইব্ন সৈয়দ আশরফ মক্কী (১৪৯৩-১৫১৮) একজন ধর্মপ্রাণ শাসক ছিলেন। তাঁর আমলে বাংলা অঞ্চলে সর্ব প্রথম হাদিস চর্চা শুরু হয় এবং তিনি ১৫০২ সালে মালদহে ধর্মীয় শিক্ষার উদ্দেশ্যে একটি মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন। তাছাড়া সুলতান ইলতুতমিসের সময় দিল্লি­ থেকে বিখ্যাত মুহাদ্দিস শায়খ শরফুদ্দিন আবু তাওয়ামাহ সোনারগাঁওয়ে আগমন করে পূর্ব বাংলা অঞ্চলে সর্ব প্রথম হাদিস চর্চা শুরু করেন বলে ইতিহাসে স্বীকৃত। পরবর্তীকালে তাঁর সান্নিধ্যে আসেন শায়খ শরফুদ্দিন ইয়াহইয়া মানিরী এবং তিনি শায়খ শরফুদ্দিন আবু তাওয়ামাহ তত্ত্বাবধানে সোনারগাঁওয়ে হাদিসের শিক্ষা প্রদান করেন। পরে ১২৯১ সালে শায়খ শরফুদ্দিন ইয়াহইয়া মানিরী পুনরায় দিল্লি­ ফিরে গিয়েছিলেন। পরবর্তীতে মাদরাসা শিক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমে হাদিস শিক্ষা এসব অঞ্চলে ব্যাপকতা লাভ করে। ১৭৮১ সালে কলিকাতা আলিয়া মাদরাসা প্রতিষ্ঠিত হয়। আলীয়া মাদরাসার পাশাপাশি কাওমী ধারার মাদরাসাগুলোও যুগ যুগ ধরে হাদিস শিক্ষা প্রদান করে আসছে।

ইসলাম প্রচার ও প্রসারে যারা কাজ করছেন তাদের উচিত সাধারণ মানুষকে সহিহ হাদিস চর্চার গুরুত্ব বুঝিয়ে বলা। আল্ল­াহ আমাদের সবাইকে সেই তাওফিক দিন। আমীন!

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন