রাজিক একিলিসের নাম প্রথম শোনে তার বন্ধু হাসনাইন কাদিরের মুখে। হাসনাইন কাদিরের কাছে সে গিয়েছিল টাকা ধার করতে। টাকা ধার পেল না বটে, কারণ হাসনাইনের নিজেরই নাকি নেই, তবে রাজিক একিলিসের কথা শুনল। হাসনাইন কাদির লেখালেখি করে। তাকে দেশের লোকজন জানে, সে অনেক পুরস্কারও পেয়েছে, প্রায় তাকে বিভিন্ন টেলিভিশনেও দেখা যায়, তার বইয়ের সংখ্যাও অনেক। তবে রাজিক তার কোনো লেখা পড়েনি। একবার পড়তে নিয়ে দেখেছিল—কঠিন গল্প কোত্থেকে কোথায় চলে যাচ্ছে, বোঝাই মুশকিল। এ গেল গল্পের কথা, হাসনাইন কাদির কবিতাও লেখে। কবিতা রাজিক কিছুই বোঝে না।
এই যে রাজিক কবিতা বোঝে না, তার সাহিত্যজ্ঞান নেই, এসব হাসনাইন কাদিরের জানা। তবু, রাজিককে কাছে পেলে, সে সাহিত্য নিয়েই আলোচনা করে। আজও যেমন, সাহিত্য নিয়ে কী ভাবছে সে, কোন-কোন পরিকল্পনা তার মাথায় ঘুরছে, এসব সে সময় নিয়ে রাজিককে জানাল। আজ ফোন করার সময় রাজিক গলার স্বর স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করেছিল। তার একটা সমস্যা আছে; না, বন্ধুদের কাছ থেকে টাকা ধার করা সে অস্বাভাবিক কিছু মনে করে না, সমস্যা হলো—টাকা ধার চাওয়ার সময় তার গলার আওয়াজ কেমন যেন হয়ে যায়, বন্ধুরা সহজেই টের পেয়ে যায়, সুতরাং সে পুরোপুরি চাওয়ার আগেই বন্ধুরা কথা ঘোরায় কিংবা জানিয়ে দেয়—তার নিজেরই কত অসুবিধা। সুতরাং রাজিক আজ একটা হালকা-হালকা ভাব ধরে রাখার চেষ্টা করল, আর, হাসনাইন কাদির তাকে বলল—আরে রাজিক তুমি আছ কই?
আছি, দোস্ত, চলতেছে।
সে সবারই চলে। আমারও চলতেছে। খবর থাকলে বলো।
খবর আর কই...।
জিগাইছিলাম—আছ কই? কাছাকাছি থাকলে চইলা আসো।
আছি তো কাছেই। ভাবলাম তুমি ফ্রি থাকলে একবার ঢু মারি।
আসো আসো। আজ সারাদিন পাবে বাসায়। মাথায় নতুন গল্প ঘুরতেছে। আউলায় না যায়, সেইজন্য বাইর হই নাই। তুমি আসো।
ফোন বন্ধ করে রাজিক সীমার দিকে—কইয়া দিলাম—কাছেই আছি। আছি তিন মাইল দূরে। এখন যাইতে...।
সীমা বিরক্ত গলায় বলল—দৌড়াইতে দৌড়াইতে যাও। থামবা না। টানা দৌড়াইবা।
সীমার বিরক্ত হওয়ার কারণ আছে। আজকের দিনটা যদিও পার করা যাবে, হয়তো টেনেটুনে কালকের দিনটাও, পরের দিনটা পার করা কঠিন হয়ে যাবে। রাজিকের চাকরি নেই মাস তিনেক। এটা নতুন কিছু না। প্রায় তার চাকরি থাকে না। সীমা, এরকম একটা লোকের সঙ্গে তার বিয়ে হয়েছে বলে মাঝে মাঝে খুব আফসোস করে। এই আফসোসের বিপরীতে রাজিকের তেমন শক্ত কোনো যুক্তি নেই। সে বলে, চাকরি সে করতেই চায়, যখন করে তখন যথেষ্ট আন্তরিকতার সঙ্গেই করে, মনোযোগের সঙ্গেও, যেন কোথাও কোনো ভুল না হয়ে যায়, তারপরও যে তার চাকরি থাকে না, এটাকে সে নিয়তি ছাড়া আর কীইবা বলতে পারে।
সীমা তাকে দৌড়ে যেতে বলল, সেটা সম্ভব না, সে গেল বাসে করে। বাসের ভাড়াও আজকাল কম না। কিন্তু হাসনাইনের সঙ্গে কথা হওয়ার পর তার মন বলছে, হাসনাইন আজ তাকে নিরাশ করবে না। কিছু টাকা আজ নিশ্চয় তার কাছ থেকে পাওয়া যাবে। অবশ্য টাকাটা যে তার খুবই দরকার, এটা হাসনাইন কাদিরকে ভালোমতো বোঝাতে হবে।
পৌঁছাতে, যা লাগার কথা, তার চেয়ে কম সময় লাগল। সে ধরে রেখেছিল দেড়-দুই ঘণ্টা, তার সময় লাগল এক ঘণ্টা দশ মিনিট। হাসনাইন কাদিরকে পাওয়া গেল তার ঘরে। তার একটা আলাদা ঘর আছে। সেটা তার লেখালেখির ঘর। হাসনাইন অবশ্য সে-ঘরের নাম দিয়েছে ‘চিন্তা-ঘর’। হাসনাইন ছিল চিন্তা-ঘরে। রাজিককে দেখে বলল—হোমাররে নিয়া কিছু লিখব ভাবতেছি। হোমার এক আশ্চর্য ব্যাপার।
রাজিক হাসল—দোস্ত, অনেকদিন পর দেখা, আছ কেমন?
হাসনাইন কাদির বলল—এইটা বলো, হাসনাইন কাদিরকে তোমার কেমন লাগে?
রাজিক হাসান চেষ্টা করল, পারল না, তবে মুখ সে হাসিহাসি করে রাখতে পারল।
হাসনাইন কাদির চেয়ার ছেড়ে উঠল, ঘরের ভেতর কিছুক্ষণ পায়চারি করল—প্রথমে ঠিক করলাম একটা দীর্ঘ কবিতা লেখব। নামও ঠিক করলাম—হোমারের সঙ্গে কয়েকটি সন্ধ্যা। পরে মনে হলো, না, এটা কবিতায় আনা যাবে না।... যাবে হয়তো, আমি পারব না। তখন ঠিক করলাম উপন্যাস লিখব। নাম অবশ্য এখনো ঠিক করি নাই।
রাজিক এবার হাসিটা ফোটাতে পারল—এইসব কি আমি বুঝি?
কিন্তু হোমারের ইলিয়াড, এইটা কী অসাধারণ রচনা, এইটা তুমি জানো।
পড়ি নাই তো।
পড়ো নাই!... ও হো হো, তুমি যে পড়ো না, এইটা আমার মাথায়ই নাই।
হোমার কে?
লেখক।...কবি। বহু আগে তিনি দুইটা অসামান্য...।
হাসনাইন, এইসব আমি বুঝব না।
অবশ্যই বুঝবে। কারণ তার লেখায় গল্প আছে। দুর্দান্ত গল্প। গল্পের ভেতর আর কী আছে, এইটা তুমি বুঝবা না। কিন্তু সেইটা বোঝারই বা কী দরকার! রাইরেরটা বুঝলেই তুমি মুগ্ধ।
তুমি কোনটা বুঝো?
কী আশ্চর্য, আমি দুইটাই বুঝি। যেমন কাহিনি তেমন চরিত্র। কী যে চরিত্র একেকটা! কী বীরত্ব, কী দ্বন্দ্ব, চরিত্রে-চরিত্রে কী সংকট, কী তাদের বাসনা, কী তীব্র প্রেম, কী প্রবল আত্মমর্যাদা, কী অহংকার।... রাজিক তুমি সত্যই ইলিয়াড পড়ো নাই!
আমার পড়তে ভালো লাগে না, তুমি জানো। মজা পাই না।
আমি এইটা তোমাকে পড়তে দেবো, দেখবা...।
হাসনাইন... ।
আমি উপন্যাসের একটা ছক মোটামুটি তৈরি করেছি। মানে, কীভাবে লিখব উপন্যাসটা। ঠিক করেছি, এভাবে দেখাব—আমি আর হোমার চলে গেছি ট্রয়ের যুদ্ধক্ষেত্রে, ঘুরে বেড়াচ্ছি, যুদ্ধ চলছে তখন, ঘটনা ঘটছে, আর, আমরা দুজন তা বিশ্লেষণ করছি...।
রাজিক বলল—হাসনাইন...।
শুনব তোমার কথা। তুমি কী বলবে, তা আমি জানি। আগে আমার কথা শোনো। চা খেলে ফ্লাস্ক থেকে ঢেলে নাও।... আমার জন্যও ঢালো।... এখন শোনো চরিত্র ইলিয়াড। হেলেন, প্যারিস, হেক্টর, নেস্তর, মেনেলাস আগামেমনন, রাজা প্রাইম, ইউলিসিস, একিলিস... একিলিস। একিলিসের কথা কী বলব তোমাকে! ইলিয়াডের সব চরিত্রই অসাধারণ, কিন্তু একিলিস দুর্দান্ত, এমন একটা চরিত্র যদি কোনো লেখক তৈরি করতে পারেন...।
দুই.
একিলিসের কথা রাজিক সীমাকে বলার সুযোগ পেল রাতে। সন্ধ্যা পর্যন্ত তাদের ঠাণ্ডা সময় গেল। ফিরতে-ফিরতে রাজিকের দেরি হয়ে গিয়েছিল। কারণ হাসনাইন কাদির তাকে একিলিসের গল্প শোনাচ্ছিল। গল্পটা আসলে শুধু একিলিসের না, তবে ইলিয়াড পুরোটা বলতে অনেক সময় লাগবে, তাই হাসনাইন জোর দিয়েছিল একিলিসের ওপর।
সেই গল্প শুনে রাজিক মুগ্ধ—কী বলো তুমি, পুরাই অজেয়...।
অজেয়।
হ্যাঁ, পুরাই অজেয়, কিন্তু অতবড় বীরের একটা খুঁত।
হুমম, একটাই খুঁত।
ঐ একটা খুঁত না থাকলে প্যারিসের তীর তার গোড়ালিতে বিঁধত না?
না।
তাহলে, ঐ খুঁত না থাকলে কেউ তাকে হারাতে পারত না?
খুঁত বলো, দুর্বল জায়গা বলো, তোমার-আমার সবার থাকে রাজিক।
বিকালের দিকে বাসায় ফিরে রাজিক দেখল সীমা আর পাশের বাড়ির শামসের ড্রইংরুমে বসে গল্প করছে। সদর দরজা খোলাই ছিল। রাজিক দরজা ঠেলে ঢুকতে ঢুকতে তাদের হাসির শব্দ পেল! রাজিক অবশ্য দাঁড়াল না। সে চলে এল ভেতরে। জামাকাপড় বদল করে বিছানায় বসল মাত্র, শামসের গলার আওয়াজ পাওয়া গেল বাইরে, তাদের বাড়ি ছোট, বেডরুম থেকে দু পা দূরত্বে ড্রয়িংরুম, তার বাইরে দাঁড়িয়ে শামসের বলল—রাজিক ভাই, গেলাম। আপনে ছিলেন না, ভাবি ভয় পাইতে ছিলেন, তাই তারে সঙ্গ দিলাম। এখন আপনে আসছেন, আমি যাই।
রাজিক কোনো উত্তর না দিয়ে বিড়বিড় করে বলল—হারামজাদা, তুমি মজা নাও?
বাইরের দরজা বন্ধ করার শব্দ হলো, তার পরপরই সীমাকে দেখা গেল দরজায়—টাকা এনেছ?
রাজিক চুপ করে থাকল।
চুপ কইরা থাকলে আমি কী বুঝব! এনেছ?
না, পাই নাই।
কার কাছে গেছিলা?
হাসনাইনের কাছে।
সে টাকা দিব! সে হইতেছে লুচ্চা। বাজারে তার দুর্নাম। অল্পবয়সী মাইয়া নিয়া ঘুরে।
এইসব তোমারে কে বলছে?
কানে আসে।... একবার আমার দিকে ক্যামনে তাকাইছিল, মনে নাই?
এইটা তোমার মনের ভুল। সে কিন্তু প্রথমেই বলছিল, তার চোখের সমস্যা যাইতেছে।
তা-ই! আরেকবার ফোনে কী যেন বলছিল...।
সীমা, সেইটা তেমন কিছু না।
তুমি খামাখা বন্ধুরে টাইনো না, তারে সবাই চিনে। বলতে বলতে সীমা তার ব্লাউজের ভেতর থেকে টাকা বের করে রাজিকের দিকে বাড়িয়ে দিতে দিতে বলল—যাও, বাজার কইরা আনো।
টাকা কই পাইছ?
শামস ভাইয়ের কাছে ধার নিছি।
তারে তুমি পাত্তা দাও কেন! দেখলা, যাওনের সময় কেমন ইয়ার্কি মাইরা গেল—তুমি নাকি ভয় পাইতেছিলা...।
পাইতেছিলাম... সে রসিক মানুষ।
হ, কত রস।... টাকা ব্লাউজের ভেতর রাখছ কি তার সামনেই?
না, শামস ভাই গুঁইজা দিছে...।
তুমি না...!
রাজিক বিছানায় মুখ কালো করে বসে থাকল। সীমা সেটা পাত্তা দিল না। সে টাকা বিছানার উপর রেখে হাতের অন্যান্য কাজ সারতে গেল। রাজিক কতক্ষণ মুখ কালো ও গুম করে থাকার পর উঠে বাজারে গেল, তার অবশ্য বেশ লজ্জা লাগল। শামসের টাকা, শামসের কাছ থেকে সীমা আগেও টাকা ধার করেছে, কিন্তু রাজিক তাকে দেখতে পারে না, ফাজিল একটা, কেনইবা সীমাকে সে টাকা ধার দেয় আর কেনইবা সীমা চায়, মানে, চায় বলেই তো, আর, মাঝেমাঝেই তাদের কীসের এত গল্প, একদিন এই নিয়ে একটা মহা ঝগড়া বাধিয়ে দিতে পারলে ভালো হতো, কিন্তু ঝগড়া বাধিয়ে সীমার সঙ্গে বোধহয় কুলিয়ে ওঠা যাবে না, যেমন শামসের টাকা নিতে তার লজ্জা লাগলেও, জানলে সীমা নিশ্চয় বলবে—কই, না নিয়াও তো পারলা না—এইরকম আর কি। সুতরাং ঝগড়া-টগরা থাক। তার এসব ভাবতে গিয়ে একিলিসের কথা মনে পড়ল। তার মনে হলো, একিলিসের মতো কেউ একজন নিশ্চয় এসব মেনে নিত না। বীরের মতো সে সব মোকাবেলা করত।