বার্সেলোনা তো বটেই, ফুটবল ইতিহাসেরই তর্কসাপেক্ষে সবচেয়ে প্রভাবশালী এক চরিত্র ইয়োহান ক্রুইফ। কাতালান ক্লাবটির ইতিহাসে বহুবার হয় খেলে, না হয় খেলিয়ে কিংবা পরামর্শ দিয়ে দুঃসময়কে পেছনে ফেলার কারিগর বনেছিলেন ডাচ কিংবদন্তি। সম্প্রতি ক্লাব ইতিহাসের সবচেয়ে বাজে সময় কাটাচ্ছে বার্সেলোনা। এমন এক সময়ে ক্রুইফের অভাবটাও তাই অনুভূত হচ্ছে বেশি।
বার্সেলোনার সঙ্গে ক্রুইফের সম্পর্কের শুরু ১৯৭৩-৭৪ মৌসুমে, তখন কাতালুনিয়ায় চলছে লিগ শিরোপার খরা। আগের মৌসুমেই আয়াক্সকে ইউরোপসেরা করা ডাচ এই মিডফিল্ডারকে দলে ভিড়িয়ে কোচ রাইনাস মিকেলসের অধীনে ১৩ বছরের লিগ শিরোপা খরা কাটায় বার্সেলোনা।
১৯৮৮ সালে ক্রুইফ দ্বিতীয়বার যখন বার্সেলোনায় এলেন, ভূমিকাটা বদলে গেল। দুই বছর আগে সেভিলে ইউরোপিয়ান কাপের ফাইনালে স্টয়া বুখারেস্টের কাছে হারে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত দল আর দায়িত্ব নেওয়ার কিছুদিন আগেই সভাপতি উনাই নুনিয়েজের বিপক্ষে খেলোয়াড়দের কুখ্যাত আন্দোলন ‘হেস্পিরিয়া ম্যুটিনি’র ধাক্কা সামলানোর দায়িত্বটা বর্তায় কোচ ক্রুইফের কাঁধে।
এমন দলকে বছর চারেকের ভেতরেই খোলনলচে পালটে দিয়ে জেতান প্রথম চ্যাম্পিয়ন্স লিগ শিরোপা। তবে আরো বড় কাজটা করেছিলেন ‘লা মাসিয়া’র ধারণা দিয়ে। তার পরামর্শেই খেলোয়াড় কেনা থেকে অ্যাকাডেমি গড়ে খেলোয়াড় উত্পাদনের পথে আসে বার্সেলোনা। সেটা না হলে জাভি-মেসি-ইনিয়েস্তাদের স্বর্ণসময় দেখত কি না কাতালান দলটি তাও তর্কসাপেক্ষ এক ব্যাপার। শারীরিকভাবে শক্তিশালীদের বদলে বল পায়ে বুদ্ধিমান খেলোয়াড়দের প্রাধান্য দেওয়ার চলটাও যে তৈরি করেছিলেন ক্রুইফই!
এরপর ১৯৯৬ এর দিকে ক্লাব ছাড়লেন, তবে যোগাযোগটা রয়ে গেল দুই পক্ষের। ২০০৩ সালে ফ্র্যাঙ্ক রাইকার্ডকে দলের কোচ করার সময়েও পরামর্শ ছিল তার। পরে সেই রাইকার্ডই দলকে দ্বিতীয়বারের মতো ইউরোপসেরার মুকুট পরান কাতালান দলটিকে।
২০০৮ সালে টানা দুই শিরোপাহীন মৌসুমে পর্যুদস্ত বার্সেলোনা যখন হোসে মরিনহোকে দলের কোচ করতে উদ্ধত, তখন ‘অনভিজ্ঞ’ পেপ গার্দিওলাকে কোচ করার প্রস্তাবও দিয়েছিলেন বার্সার এই প্রবাদপুরুষ। এক বছর পর তো ইতিহাসই নতুন করে লিখেন সেই ‘অনভিজ্ঞ’ গার্দিওলা।
সোনালি এক প্রজন্ম নিয়েও ২০১৩-১৪ মৌসুমে বড় শিরোপা জিততে ব্যর্থ হয় বার্সেলোনা। পরের মৌসুমে ভাবি কোচ লুইস এনরিকেকে রিয়াল মাদ্রিদে যোগ দেওয়া থেকে রুখে বার্সার কোচ হওয়ায় উদ্বুদ্ধ করার কারিগরও সেই ক্রুইফই। আগের মৌসুমে বার্সেলোনা যখন নেইমারকে দলে ভেড়ায় তার প্রতিবাদ করেছিলেন সাবেক এই বার্সেলোনা কোচ। বলেছিলেন, ‘নেইমারকে রাখতে হলে মেসিকে বেচে দাও। দুজন একসঙ্গে থাকতেই পারবে না।’
মৌসুম চারেক পর নেইমার নতুন চ্যালেঞ্জের আশায় দল ছেড়ে ক্রুইফের কথাই সত্যি প্রমাণিত করেছিলেন। ২০১৬ সালে না ফেরার দেশে চলে যাওয়া দূরদৃষ্টি সম্পন্ন এই ফুটবল মস্তিষ্ক কাতালান ক্লাবটিকে কমপক্ষে পাঁচবার দুর্দিন পেছনে ফেলার রসদ জুগিয়েছিলেন। শেষ দুই মৌসুমে রোমা আর লিভারপুলের কাছে চ্যাম্পিয়ন্স লিগে বড় দুটো হার সতর্কবার্তা জানাচ্ছিল দলকে। সেটা ধরতে ব্যর্থ হয়েছে কাতালানরা। যারই ফল বায়ার্ন মিউনিখের কাছে লিসবনে দেখা সর্বশেষ বিপর্যয়।
ইতিহাস বলছে, ক্লাবের এমন দূর্দিন কিংবা এর সতর্কবার্তা আগ থেকেই আঁঁচ করার ক্ষমতা ছিলো দূরদৃষ্টিসমপন্ন ক্রুইফের। তিনি থাকলে ক্রমেই বুড়ো হতে থাকা মূল খেলোয়াড়দের ওপর নির্ভরতা ছেড়ে নতুন করে দলকে ঢেলে সাজানোর কিংবা অন্য কোনো ইতিহাস বদলে দেয়া পরামর্শও যে দিতেন, সে ভাবনাটা উড়িয়ে দেয়া যাচ্ছে না মোটেও। সেটা হলে সাম্প্র্রতিক সময়ে রীতিমতো দিশেহারা পরিস্থিতি নিশ্চিতভাবেই তৈরি হতো না বার্সার। ক্লাবের এ দুঃসময়ে তাই ধীমান এই ফুটবল মস্তিষ্কের অভাবটা ভালোভাবেই টের পাচ্ছে বার্সেলোনা।