শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

শিশুদের অমার্জনীয় শাস্তি

আপডেট : ২৫ ডিসেম্বর ২০১৮, ২১:১৩

কয়েকদিন আগে অফিস থেকে বাসায় ফিরে আমার প্রথম শ্রেণি পড়ুয়া মেয়েকে আনন্দে সারা ঘর লাফাতে দেখলাম। আমি এ খুশির কারণ জানতে চাইলে সে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল, বাবা জান, মন্ত্রী বলেছেন আর শিক্ষকরা ছাত্রদের মারতে পারবেন না। এ কথা বলেই সে আবার লাফাতে শুরু করে। আমারও মনে পড়ল কাগজে দেখেছি শিক্ষামন্ত্রী কয়েকদিন আগে ছাত্রছাত্রীদের শারীরিকভাবে আঘাত না করার জন্য শিক্ষকদের অনুশাসন প্রদান করেছেন। আমার মেয়ের অবস্থা দেখে মুহূর্তেই আমার জীবনের প্রায় ৫০ বছর আগের মক্তব (সকালবেলা মসজিদের বারান্দায় আরবি শিক্ষাকেন্দ্র), প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার কথা মনে পড়ে গেল। সেকালের শাস্তির ধরন এখনো মনে ভীতির সঞ্চার করে। আর ভয়াবহ ভীতির সঞ্চার হয় যখন কুসংস্কারাচ্ছন্ন ও অজ্ঞ সমাজ ওস্তাদদের মারধরকে আশীর্বাদ হিসেবে গ্রহণ করে।

কোমলমতি ছাত্রদের নির্মম শাস্তির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল ‘নীলডাউন’। এটা অনেকটা কচ্ছপের মতো দুপায়ের নিচ দিয়ে হাত এনে কানে ধরে বসে থাকা। যা ছিল এক অমানবিক ও নিষ্ঠুর শাস্তি। ‘কানমলা’ ছিল আর এক ভয়াবহ শাস্তি। কানটা শরীর থেকে কিছুটা বাইরে রাখা হয়েছে সম্ভবত আল্লাহতায়ালা সৃষ্টির শব্দ রহস্য সুচারুভাবে অনুধাবন করার জন্য। কিন্তু ওস্তাদরা কারণে-অকারণে সীমা লঙ্ঘন করে কানের বর্ধিত অংশের উপর এমনভাবে অত্যাচার করতেন, যার ফলে অনেক নিরীহ নিষ্পাপ শিক্ষার্থী বধির হয়েছে এবং অনেকে শিক্ষালয় থেকে চিরতরে দূরে চলে গেছে। ঈশ্বরদীতে উপজেলা ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে তথাকথিত ওস্তাদের থাপ্পড়ে কোমলমতি এক ছাত্রের কানের পর্দা ফেটে যাওয়ার অভিযোগ দায়ের হয়েছিল। অভিযোগ দায়েরবিহীন অবস্থায় এদেশে কত নিরীহ ছাত্রের কানের পর্দা ফেটেছে তার হিসাব আমাদের জানা নেই। এছাড়া একজনকে দিয়ে আরেকজনের কান মলানো, দু’জনকে দিয়ে একে-অপরের কান ধরে উঠবস করানো, দাঁড় করিয়ে রাখাসহ হরেক রকম অত্যাচারের কুটকৌশল তো ছিলই।

হাতের তালু শক্ত চামড়া ও অসংখ্য নার্ভ দ্বারা আবৃত থাকায় মানুষ সহজে শক্ত কাজ করতে পারে এবং হাতের সংস্পর্শে আসা সবকিছু দ্রুত অনুভব করতে পারে। শরীরের অন্য জায়গার চামড়ার তুলনায় এটি সহজে ছিঁড়ে বা ফেটে যায় না, তাই বলে কি ওস্তাদরা এটিকে বেত্রাঘাতের উত্তম স্থান ধরে নিয়ে আঘাত করবেন? আর নিয়ম ছিল বেত্রাঘাতের সময় বেত্রাঘাতকারীর সুবিধার জন্য সামনের দিকে হাত মেলে ধরতে হবে। না ধরলে শয়তানের প্ররোচনা হিসেবে আখ্যায়িত করে আঘাতের পরিমাণ দ্বিগুণ-তিনগুণ বেড়ে যেত এবং সেক্ষেত্রে শরীরের সর্বত্র এলোপাতাড়ি বেত্রাঘাত চলত। হাতের তালুর চামড়া কিন্তু শরীরের অন্যান্য জায়গার মতো সহজে নিরাময়যোগ্য নয়। একবার ক্ষত হলে দাগ থেকে যাবে। এ দেশের অগুনতি হাতের তালুতে নির্মম এ অত্যাচারের দাগ গবেষণা করে বের করার প্রয়োজন নেই একটু খোঁজ নিলেই বিস্তর পাওয়া যাবে।

আমার জানা নেই বর্ণিত অনাচার থেকে আমরা কি পরিমাণ দূরে এসেছি। তবে ভদ্র ও সভ্য সমাজের অংশ হিসেবে অবশ্যই এ জাতীয় অনাচার থেকে আমাদেরকে মুক্তি পেতে হবে। সৃজনশীল ও আত্মমর্যাদাশীল এবং পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ সম্পন্ন সমাজ গড়ার লক্ষ্যে আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম, বর্তমান শিশুদেরকে নিপীড়ন, নির্যাতন ও অপমানের হাত থেকে রক্ষার সামাজিক ও নৈতিক দায়িত্ব পালনে সংকল্পবদ্ধ হতে হবে। মন্ত্রীর অনুশাসন অক্ষরে অক্ষরে পালিত হোক এবং আমার প্রথম শ্রেণি পড়ুয়া মেয়ের আনন্দ চিরস্থায়ী হোক। 

n লেখক :সাবেক অতিরিক্ত সচিব