বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

ভোটের পর নীরব রাজনীতিতে দুর্নীতিবিরোধী অভিযানে উত্তাপ

আপডেট : ৩০ ডিসেম্বর ২০১৯, ২২:৫৫

একাদশ সংসদ নির্বাচনে (২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর) ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও দলটির নেতৃত্বাধীন জোটের নিরঙ্কুশ বিজয়ের আলোচনার মধ্য দিয়েই শুরু হয়েছিল ২০১৯ সাল। আওয়ামী লীগের সরকার গঠন এবং নির্বাচনে ক্ষমতাসীন জোটের প্রধান প্রতিপক্ষ বিএনপিসহ জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের মাত্র আটটি আসনে জয়লাভ নিয়ে বছরের শুরুতে কিছুদিন চলে নানামুখী বিশ্লেষণ। এরপর বছর জুড়েই রাজনৈতিক অঙ্গন ছিল প্রায় নিরুত্তাপ। ২০১৯ সালের ক্যালেন্ডারের পাতা উলটিয়ে চোখ বুলালে ও ঘটনাপ্রবাহ পর্যালোচনা করলে বড়ো ধরনের কোনো ঘটনা নেই রাজনীতিতে। তবে সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে দুর্নীতি-ক্যাসিনো-জুয়া-মাদক-টেন্ডারবাজিবিরোধী অভিযানে কিছুটা উত্তাপ দেখা দেয়। বিশেষ করে, যুবলীগের প্রভাবশালী কয়েক নেতার ধরপাকড় ও পদচ্যুত হওয়ার ঘটনা নতুন মাত্রা যোগ করে।

নির্বাচনের ফল প্রত্যাখ্যান ও বর্তমান সংসদকে ‘অবৈধ’ আখ্যা দিয়েও নানা নাটকীয়তার পর সংসদে প্রথমে ঐক্যফ্রন্টের শরিক গণফোরামের দুই সদস্যের, এরপর বিএনপির একজনের ও শেষ পর্যন্ত বিএনপির বাকি পাঁচ জনেরই সংসদে যোগদানের ঘটনা আলোচনার জন্ম দেয়। আর ‘শিগগিরই সরকারবিরোধী আন্দোলন’ বলে-বলে বছর পার করেছে বিএনপি। দলের কারাবন্দি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে মুক্ত করতে নানা হাঁকডাক দিয়েও বিএনপি প্রতিবারই ‘নরম’ কর্মসূচি পালন করেছে। সালতামামি বলছে, বছরের শেষ মাস ডিসেম্বরেও বিএনপি বলেছিল, ‘খালেদা জিয়ার জামিন না হলে এক দফার আন্দোলন।’        তবে সেটিও হুংকার পর্যন্তই সীমাবদ্ধ থেকেছে। এছাড়া উন্নত চিকিত্সার জন্য খালেদা জিয়া বিদেশে যেতে পারেন বলেও কিছুদিন পরপরই খবর হয়েছে সংবাদমাধ্যমে।

অজানা কিছু আশঙ্কা থাকলেও শেষ পর্যন্ত বলতে গেলে প্রায় নির্বিঘ্নে ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচন পার করার পর বিদায় নিতে যাওয়া বছরের কখনোই রাজনৈতিকভাবে তেমন বেগ পেতে হয়নি আওয়ামী লীগকে। বছরের প্রায় পুরো সময়ই রাজনৈতিক অঙ্গন শান্ত থাকলেও বুয়েটের আবরার হত্যাকাণ্ড, ফেনীর মাদ্রাসার ছাত্রী নুসরাতকে পুড়িয়ে হত্যা, বরগুনায় রিফাতকে হত্যা, বালিশ-পেঁয়াজ-লবণ কাণ্ড ও একের পর এক গুজবের ঘটনা ভাবিয়েছে সরকারকে। বনানীর এফ আর টাওয়ারসহ বেশ কয়েকটি অগ্নিকাণ্ড, বুয়েট ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অচলাবস্থা, ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ বিবাদে কয়েকটি ঘটনায় রক্ত ঝরা, একাধিক রেল দুর্ঘটনা, নতুন সড়ক আইন নিয়ে যানবাহনের মালিক-চালক-শ্রমিকদের অবরোধ এবং পাটকল শ্রমিকদের ধর্মঘটের মতো ঘটনাও সামাল দিতে হয়েছে সরকারকে।

‘আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি—একাদশ সংসদ নির্বাচনে দেশের মানুষ ভোট দিতে পারেনি’ অক্টোবরে বরিশালে দলীয় এক সভায় ১৪ দল শরিক বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেননের এই বক্তব্য রাজনীতিতে ঝড় তোলে। ১৪ দলের পক্ষ থেকে মেননের কাছে বক্তব্য সম্পর্কে ব্যাখ্যা চাওয়া হয়। জবাবে দুঃখ প্রকাশ করেন মেনন। তবে মেননের বিস্ফোরক মন্তব্য নিয়ে সংসদের ভেতরে-বাইরে কিছুদিন বিতর্ক চলে। ঢাকা-৮ আসন থেকে নির্বাচিত মেননের সংসদ সদস্য পদে বহাল থাকতে পারা না পারা নিয়েও প্রশ্ন ওঠে। এ ঘটনার প্রায় দুই মাসের মাথায় ২৯ নভেম্বর মেননের পার্টি ভাঙনের মুখে পড়ে।

বিদায় নিতে যাওয়া ২০১৯ সালে খবরের শিরোনাম হন বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দল শরিক এলডিপি সভাপতি ড. কর্নেল (অব.) অলি আহমদও। ২০ দলের সমান্তরালে তিনি গড়ে তোলেন ‘জাতীয় মুক্তি মঞ্চ’ নামে পৃথক মঞ্চ। অলির সঙ্গী হয় ২০ দল শরিক জামায়াত ও সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিমের বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি। জামায়াতকে নিয়ে আলাদা মঞ্চ বানানোয় ভাঙনের মুখে পড়ে অলির দল। অলিকে সভাপতির পদ থেকে অব্যাহতি দিয়ে আরেকাংশ পৃথক এলডিপির ঘোষণা দেয়। একই ঘটনায় ইবরাহিমের কল্যাণ পার্টির মহাসচিবের পদ থেকে পদত্যাগ করেন আমিনুর রহমান। অন্যদিকে, আলটিমেটাম দিয়ে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট থেকে বের হয়ে যান বঙ্গবীর আবদুল কাদের সিদ্দিকী। ঐক্যফ্রন্ট শরিক জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জেএসডিতেও বিভক্তি দেখা দেয়। দলটির সাবেক সাধারণ সম্পাদক আবদুল মালেক রতন জেএসডি সভাপতি আ স ম আবদুর রবের বিরোধিতা করে পৃথক কাউন্সিল ডেকেছেন।

২০১৯ সালের ১৪ জুলাই জাতীয় পার্টি (জাপা) হারিয়েছে দলের প্রতিষ্ঠাতা এইচ এম এরশাদকে। তার মৃত্যুর পর দলের নেতৃত্ব ও নিয়ন্ত্রণ প্রশ্নে দফায় দফায় নাটকীয়তা চলে জাপায়। সর্বশেষ ২৮ ডিসেম্বর দলের কাউন্সিলে রওশন এরশাদকে ক্ষমতাহীন ‘প্রধান পৃষ্ঠপোষক’ করে একচ্ছত্র ক্ষমতা নিজ হাতে রেখে চেয়ারম্যান পদে বহাল থাকেন এরশাদের সহোদর জিএম কাদের। সবমিলিয়ে এরশাদের অসুস্থতা ও মৃত্যু এবং দলের অভ্যন্তরীণ বিবাদেই বছরটি পার করেছে সংসদের প্রধান বিরোধী দল জাপা। এর মাঝে নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে শহিদ নূর হোসেনকে নিয়ে আপত্তিকর মন্তব্য করে সংসদের ভেতরে-বাইরে ও নিজ দলে তোপে পড়েন জাপা মহাসচিব মসিউর রহমান রাঙ্গা। এছাড়া একাদশ সংসদে সংরক্ষিত নারী আসনে দলের প্রার্থীদের কাছ থেকে লিখিত চুক্তি করে অর্থ নেওয়ার ঘটনায়ও এবছর আলোচনায় আসে এরশাদের রেখে যাওয়া জাপা।