শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

ছাত্রলীগের হামলায় শিক্ষক সাংবাদিকসহ আহত ৩৫

আপডেট : ০৫ নভেম্বর ২০১৯, ২২:১৮

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে  উপাচার্য অধ্যাপক ফারজানা ইসলামের অপসারণের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের উপর হামলা চালিয়েছে ছাত্রলীগ। গতকাল মঙ্গলবার এ হামলায় আট শিক্ষকসহ অন্তত ৩১ জন আহত হয়েছেন। এছাড়া দায়িত্ব পালনকালে মারধরের শিকার হন বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪ সাংবাদিক। এ ঘটনার পর দুপুরে জরুরি সিন্ডিকেট সভা ডেকে বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করেছে প্রশাসন। এ ঘোষণার পর হল ছাড়তে শুরু করেছেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা। বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধের প্রতিবাদে বিক্ষোভ মিছিল বের করেন আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা। তারা বন্ধের মধ্যেই ভিসিবিরোধী আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন।

এদিকে উপাচার্যবিরোধী আন্দোলনকারীদের ওপর হামলার প্রতিবাদে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক সোহেল রানা, কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক মনোয়ার হোসেন তুহিন, সদস্য অধ্যাপক মাহবুব কবির ও সদস্য অধ্যাপক সাঈদ ফেরদৌস শিক্ষক সমিতির পদ থেকে পদত্যাগ করেছেন।

জানা গেছে, ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে জাহাঙ্গীরনগর’ ব্যানারে আন্দোলনরত        শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের উপর হামলা চালিয়ে আন্দোলনকারীদের উপাচার্যের বাসার সামনে থেকে হঠিয়ে দেওয়ায় দীর্ঘ দশদিন পর অফিসে প্রবেশ করেন উপাচার্য। তাকে আন্দোলনকারীদের কাছ থেকে ‘মুক্ত’ করায় ছাত্রলীগকে ধন্যবাদ দেন উপাচার্য। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনে সাংবাদিকদের উপাচার্য বলেন, ‘আমার সহকর্মীসহ ছাত্রলীগের প্রতি আমি কৃতজ্ঞ। কারণ তারা দায়িত্ব নিয়ে এ কাজটি করেছে। এখন সুষ্ঠুভাবে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার জন্য সবাই আমাকে সর্বোচ্চ সহযোগিতা করবেন।’

জাবি উপাচার্য অধ্যাপক ফারজানা ইসলামের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তুলে তাঁর পদত্যাগের দাবিতে প্রায় দুই মাস ধরে আন্দোলন করে আসছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। পদত্যাগের আল্টিমেটামের পরও তিনি পদত্যাগ না করলে আন্দোলন আরো জোরদার করেন আন্দোলনকারীরা। এর মধ্যেই শিক্ষামন্ত্রী আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আলোচনায় বসে বিষয়টি তদন্তের আহ্বান জানালে আন্দোলনকারীরা তা নাকচ করে আন্দোলন চালিয়ে যান। সোমবার সন্ধ্যায় আন্দোলনকারীরা উপাচার্যের অপসারণ দাবিতে তার বাসভবনের সামনে অবস্থান নিয়ে তাকে অবরুদ্ধ করে রাখেন। গতকাল বেলা বারোটার দিকে উপাচার্যপন্থি শিক্ষকরা উপাচার্যকে বাসা থেকে বের করতে গেলে ব্যর্থ হন। এরপরেই বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা শিবির মুক্ত ক্যম্পাসের দাবিতে মিছিল নিয়ে আন্দোলনকারীদের উপর হামলা করে। হামলায় আন্দোলনকারী শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও সাংবাদিকসহ অন্তত ৩৫ জন আহত হন। আহতদের বিশ্ববিদ্যালয় মেডিকেল সেন্টারে প্রাথমিক চিকিত্সা দিয়ে ২০ জনকে সাভার এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে উন্নত চিকিত্সার জন্য পাঠানো হয়।

হামলায় আহত শিক্ষকরা হলেন- নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সাইদ ফেরদৌস, মীর্জা তাসলিমা সুলতানা, দর্শন বিভাগের অধ্যাপক রায়হান রাইন, প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক, ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক খন্দকার হাসান মাহমুদ, বাংলা বিভাগের অধ্যাপক শামীমা সুলতানাসহ আরো দুই শিক্ষক। মারধরে আহত শিক্ষার্থীদের মধ্যে- ৪৪ তম আবর্তনের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের মরিয়ম ছন্দা, দর্শন বিভাগের মারুফ মোজাম্মেল, ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের মাহাথির মুহাম্মদ, পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের সাইমুম ইসলাম, নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের রাকিবুল ইসলাম রনি, ৪৫তম আবর্তনের দর্শন বিভাগের রুদ্রনীল আহমেদ, প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের সৌমিক বাগচী, ৪৭তম আবর্তনের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের সাউদা, ৪৮ তম আবর্তনের ইংরেজি বিভাগের আলিফ মাহমুদ, অর্থনীতি বিভাগের উল্লাসের নাম জানা গেছে।

এছাড়া সংবাদ সংগ্রহের সময় ছাত্রলীগের হামলায় আহত সাংবাদিকরা হলেন- প্রথম আলোর বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি মাইদুল ইসলাম, বার্তা ২৪ ডট কমের প্রতিনিধি রুদ্র আজাদ, বার্তাবাজারের প্রতিনিধি ইমরান হোসাইন হিমু ও বাংলালাইভ ২৪ ডট কমের প্রতিনিধি আরিফুজ্জামান উজ্জল। এ ঘটনার পরে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন জরুরি সিন্ডিকেট ডেকে অর্নিদিষ্টকালের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করে এবং সাড়ে ৫টার মধ্যে শিক্ষার্থীদের সকল আবাসিক হল ছাড়তে নির্দেশ দেয়। এ খবর ছড়িয়ে পড়লে প্রায় ৩০০জন শিক্ষক-শিক্ষার্থী মিছিল নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে আবার উপাচার্যের বাসা অবরোধ করতে গেলে সেখানে অবস্থানরত ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা তাদের বাধা দেয়। তাদের বাধায় আন্দোলনকারীরা উপাচার্যের বাসভবন সংলগ্ন সড়কে অবস্থান নেয়। এসময় তারা উপাচার্যের অপসারণ না হওয়া পর্যন্ত অবস্থান থেকে সরবেন না বলে জানান। একই স্থানে আন্দোলনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করেছেন শাখা ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। পরে আন্দেলনকারীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবহন চত্বরে এসে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস চলাচল বন্ধ করে দেন।

এদিকে ছাত্রলীগ ও আন্দোলনকারীদের পাল্টাপাল্টি অবস্থানের কারণে ক্যাম্পাসে আবারো হামলার আশঙ্কা করা হচ্ছে। যেকোন ধরনের অস্থিতিশীল পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে পুলিশের সহযোগিতা কামনা করেছে প্রশাসন। গতকাল বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে সাভার ও আশুলিয়া থানা ওসির কাছে এ সহযোগিতা চাওয়া হয়।

আন্দোলনকারীদের ওপর হামলার বিষয়ে আন্দোলনকারী শিক্ষক পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক খবির উদ্দিন বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে এরকম ন্যাক্কারজনক হামলার ঘটনা ইতিপূর্বে দেখা যায়নি। উপাচার্যপন্থী শিক্ষকদের উপস্থিতি ও প্রত্যক্ষ উষ্কানিতে ছাত্রলীগ আমাদের ওপর হামলা চালিয়েছে। শিক্ষকদের ওপর ছাত্রলীগের হামলা একটি নজিরবিহীন ঘটনা। ছাত্রলীগ যখন আমাদের ওপর হামলা চালিয়েছে তখন ভিসিপন্থী শিক্ষকরা তাদেরকে স্বাগত জানিয়ে হাততালি দিয়েছে।’

হামলার বিষয়ে শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি মো. জুয়েল রানা বলেন, ‘আমরা শিবিরমুক্ত ক্যাম্পাস চাই। আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে শিবির সংশ্লিষ্টতার সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছিল।’ তবে আন্দোলনে শিবির সম্পৃক্ততার অভিযোগ অস্বীকার করে আন্দোলকারীদের মুখপাত্র দর্শন বিভাগের অধ্যাপক রায়হান রাইন বলেন, ‘আন্দোলনে কোন শিবির সংশ্লিষ্টতা নেই। যেকোন শক্তিকে প্রতিহত করার জন্য শিবির ব্লেইম দেওয়াটা পুরোনো অপকৌশল। বুয়েটে আবরারকে এভাবেই হত্যা করা হয়েছে, এখানেও একইভাবে অভিযোগ তুলে হামলা চালানো হয়েছে। উপাচার্য অপসারণ আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত এমন অনেকেই আজ ছাত্রলীগের হামলায় আহত হয়েছে; যারা ক্যাম্পাসে বামপন্থী রাজনীতির পরিচিত মুখ। তাই তাদের এসব কথা দুর্নীতি ঢাকার অপকৌশল।’

হামলার বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর (ভারপ্রাপ্ত) আ স ম ফিরোজ-উল-হাসান বলেন, ‘ঘটনাস্থলে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছিল। চেষ্টা করেও আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারিনি। বড়  কোন ঘটনা এড়াতে আমরা তত্পর আছি।’ রাত ৯ টায় এ রিপোর্ট লেখার সময় ক্যাম্পাসের পরিবহন চত্বর থেকে বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে উপাচার্যের বাসভবনের সামনে  গিয়ে অবস্থান নেন আন্দোলনকারীরা।

রাবিতে পুলিশের লাঠিচার্জ

রাবি সংবাদদাতা জানান, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের উপর ছাত্রলীগের হামলার প্রতিবাদে মহাসড়ক অবরোধ করলে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে (রাবি) আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের উপর গালি দিতে দিতে লাঠিচার্জ করে পুলিশ। মঙ্গলবার সন্ধ্যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের সামনে ঢাকা-রাজশাহী মহাসড়ক অবরোধ করলে এ ঘটনা ঘটে। এসময় নর্থ বেঙ্গল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী আব্দুল্লাহ শুভ নামে একজনকে বেধড়ক পিটিয়ে আটক করে নিয়ে যায় পুলিশ। পুলিশের লাঠিচার্জে রাবির ৪ শিক্ষার্থী আহত হয়। আহতরা হলেন- মাজহারুল আলম, মোরশেদ আলম, আব্দুল মজিদ অন্তর এবং শাহরিয়ার রিদম। তাদেরকে রাবির মেডিক্যালে চিকিত্সা দেওয়া হয়।