মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

লুটের টাকা উদ্ধার কি সম্ভব?

আপডেট : ২৮ অক্টোবর ২০১৯, ২১:৩৭

ড. আর এম দেবনাথ

  যে বাঙালি কয়েক জন মিলে ১৯৭৬ সালে একটি ‘ফিন্যান্স কোম্পানি’ করার জন্য মাত্র ৩ কোটি টাকার পুঁজি সংগ্রহ করতে পারেনি, সেই বাঙালি এখন শত কোটি টাকা ক্যাশ ‘পিকআপে’ ভরে রাস্তায় রাস্তায় ঘোরে আশ্রয়ের জন্য। অবাক করা ঘটনা নয় কি? অথচ এটিই ঘটেছে। দৈনিক ইত্তেফাকের ২৬ অক্টোবরের একটি খবরের শিরোনাম হচ্ছে : ‘সেই দুই পিকআপ ভর্তি টাকার মালিক শনাক্ত’। ভেতরের খবরে বলা হয়েছে এই দুই পিকআপে ১০০টি প্যাকেটে ১০০ কোটি টাকা ছিল। ‘পিকআপ’ দুটোর শেষ গন্তব্যস্থল ছিল ফেনী। প্রথম পাতায় ছাপা খবরটি মাত্র এক কলামের ছোটো খবর। অনেকের নজরে নাও আসতে পারে। কিন্তু খবরটিতে লুক্কায়িত আছে বাঙালির ‘ক্যাপিট্যাল ফর্মেশনের’ অবিশ্বাস্য কাহিনি। মানে পুঁজি গঠনের ইতিহাস। অর্থনীতিবিদরা একে বলেন, ‘প্রাইমারি এক্যুমেলেশন অব ক্যাপিট্যাল’। এই কাজটি বরাবরই নোংরা পথে হয়। ইউরোপীয়রা যাকে বলে ‘ইচ ফার্স্ট ডলার ইজ ডার্টি ডলার’। একই প্রক্রিয়া বাংলাদেশেও কার্যকর বলে মনে হয়। নতুবা ‘ক্যাসিনো’র বিরুদ্ধে অভিযানের পর কাগজে শত শত হাজার হাজার কোটি টাকার যেসব রোমহর্ষক খবর পাওয়া যাচ্ছে এবং এদের উত্স এবং মালিক ব্যবসায়ী রাজনীতিবিদদের সম্পর্কে যা বলা হচ্ছে তার ব্যাখ্যা কী? আমরা জানি, ১৯৭৬ সালে দেশে প্রথম একটি ফিন্যান্স কোম্পানি গঠিত হয়। তার অনুমোদিত মূলধন ছিল ২০ কোটি টাকা। আর পরিশোধিত মূলধন ছিল মাত্র ৫ কোটি ৯০ লাখ টাকা। বেসরকারি এই কোম্পানিটির ৫১ শতাংশ মূলধন দেওয়ার কথা ব্যবসায়ীদের। তারা কয়েকজন মিলেও যখন ঐ টাকা সংগ্রহ করতে পারেননি, তখন সরকারি ব্যাংকের টাকা ঋণ হিসেবে তাদের দেওয়া হয়। তৈরি হয় ‘ব্যাংকের টাকায় ব্যাংক’। ১৯৮২-৮৩ সালেও একই চিত্র। তখন বেসরকারি খাতে ব্যাংক করতে কত টাকা লাগত? ৩-৪ কোটি টাকা পরিশোধিত মূলধন দিয়েই তখন পাঁচ-ছয়টি বেসরকারি ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয়। তখনো ‘ব্যাংকের ঢাকায় ব্যাংক’। কত লেখালেখি এ নিয়ে। আর আজ? ৫০০ কোটি টাকা মূলধন দিয়ে ব্যাংক করার লোক শত শত, নাকি বলব হাজার হাজার! প্রচুর টাকা, মূলধন একশ্রেণির লোকের কাছে। এমনিতে তা ছিল লোকমুখের খবর। কাগজের খবর। কিছুটা দৃশ্যমানও ছিল। না, এবার ‘ক্যাসিনো’-বিরোধী শক্ত অভিযানে পরিষ্কার হলো যে দেশে অগণিত লোক, যুবক শ্রেণির রাজনীতিক কাম ব্যবসায়ী আছেন, যাদের টাকার কোনো হিসাব নেই—দেশে এবং বিদেশে। প্রশ্ন উঠতেই পারে, এটা  কীভাবে সম্ভব হলো? এর উত্তর আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এবং অর্থমন্ত্রী কিছুদিন আগে দিয়েছেন। অক্টোবর মাসের ৩ তারিখে ইত্তেফাকের একটি খবরের শিরোনাম ছিল : ‘দল, আত্মীয়, পরিবার কাউকেই ছাড় দেওয়া হবে না :প্রধানমন্ত্রী’। খবরের ভেতরে বলা হয়েছে, ‘সরকার দেশের উন্নয়ন প্রকল্পের অর্থ উইপোকায় ধ্বংস করা থেকে রক্ষায় দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।’ অন্যত্র পড়লাম, তিনি বলছেন, ‘আমরা চলতি বাজেটে ১৭৩ হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নিয়েছি। দুর্নীতিবাজ উইপোকারা উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নকালে অর্থ লুটে নিচ্ছে। দেশের উন্নয়নের জন্য জনগণের কষ্টার্জিত প্রতিটি পয়সার যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিতের জন্য আমাদের ঐসব উইপোকাকে আটক করতে হবে।’ তার এসব কথা থেকেই বোঝা যায়, দেশে একশ্রেণির লোক, রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী ব্যক্তি, রাজনীতির সঙ্গে সম্পর্কিত ব্যক্তি বেআইনিভাবে অর্থসম্পদ করে চলেছেন। প্রধানমন্ত্রী সরকারের প্রধান। তার কথার ওপরে আর কোনো কথা নেই। অতএব তার কথা থেকেই বোঝা যাচ্ছে ‘প্রাইমারি এক্যুমেলেশন অব ক্যাপিট্যালের’ ক্রিয়া দেশে এখন শক্তিশালীভাবে বিদ্যমান। তাহলে হিসাব করতে হয় উন্নয়ন বাজেটের টাকা কত? আমার কাছে যে তথ্য আছে তাতে দেখা যায়, ২০০৮-০৯ অর্থবছর থেকে ২০১৮-১৯ অর্থবছর পর্যন্ত ১০ বছরে আমাদের ‘বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি)’ মোট বরাদ্দ ছিল ৮ লাখ ৩২ হাজার ৯০৭ কোটি টাকা। এর পূর্ববর্তী ১০ বছরে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে বরাদ্দ ছিল ১ লাখ ৮৬ হাজার ৯০০ কোটি টাকা। টাকার পরিমাণ কম হলেও ঐ টাকার বরকত বা ক্রয়ক্ষমতা ছিল অনেক বেশি। দুটো মিলিয়ে হয় ১০ লাখ ১৯ হাজার ৮০৭ কোটি টাকা। প্রশ্ন, উইপোকারা কত খেয়েছে? এর সঠিক তথ্য দেওয়া মুশকিল। এমনকি অনুমান করাও ঝুঁকিপূর্ণ। বাজারের কথা ধরলে বিরাট অঙ্ক হয়। আমরা যদি উইপোকাদের আত্মসাত্কৃত টাকা ২০ শতাংশও ধরে নিই, তাহলেও এর পরিমাণ দাঁড়ায় ২ লাখ কোটি টাকারও ওপরে। উইপোকারা শুধু এডিপি থেকেই টাকা মারেনি, তারা সরকারের নানা ধরনের ক্রয়প্রক্রিয়া থেকেও টাকা মেরেছে। ২০০ টাকার ‘বালিশ’ ক্রীত হয়েছে ২ হাজার টাকায়। হাসপাতালের রোগীদের খাবার থেকে টাকা মারা হয়েছে। তাদের ওষুধ থেকেও টাকা বানানো হয়েছে। এমনকি জেলখানার বন্দিদের/কয়েদিদের খাবারের টাকা থেকেও এই উইপোকারা টাকা মেরেছে। হিসাব করতে গেলেই বিপদ, মাথা বিগড়ে যাওয়ার  মতো ঘটনা। রয়েছে ভূমিদস্যুতা, ব্যাংকের টাকা আত্মসাত্করণ ইত্যাদি। সরকারি সম্পত্তি দখল, নদী-নালা-পাহাড়-পর্বত দখল ইত্যাদি সূত্রেও ‘চাটার দল’ বহু টাকা বানিয়েছে। মুশকিল এখানে অনেকগুলো। এই টাকার মালিকরা দেশের প্রচলিত আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখাচ্ছেন।

আমার কথা, সরকার বেআইনি অর্থসম্পদের মালিকদের বিরুদ্ধে একটা বড়ো ধরনের অভিযান শুরু করেছে। বহু লোক গ্রেফতার হয়েছে। দেখা যাচ্ছে, এদের প্রায় সবাই ক্ষমতাসীন দলের। এটা একটা বিরল ঘটনা। এদেশের কোনো সরকার নিজ দলীয় লোকদেরকে দুর্নীতির কারণে জেলে পুরেছে, এমন উদাহরণ প্রায় শূন্য। স্বভাবতই এখন এদের বিচারের কাজ চলবে। হয়তো গ্রেফতারকৃতদের লেজে লেজে আরো রুই-কাতলার নাম আসবে। এখন অপেক্ষা ঐ চিত্র দেখার জন্য। কিন্তু প্রশ্ন আছে অনেক। পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, উইপোকাদের কারণে উন্নয়ন প্রকল্পের খরচ বেড়ে যাচ্ছে। এক টাকার কাজ করতে হচ্ছে দুই টাকায়, তিন টাকায়। এটা সরকারি টাকা ব্যয়ের/ব্যবহারের গুণগত দিক। খরচের গুণগত দিক নিশ্চিত না হওয়ার ফলে অর্থনীতিও ব্যয়বহুল হয়ে পড়ছে, যার সমাধান দরকার এখনই। কারণ ব্যয়বহুল অর্থনীতি সাধারণ মানুষের কষ্ট বাড়ায়, তাদের বোঝা বাড়ায়, বৈদেশিক ঋণ বাড়ায়। এক দিনে গুণগত ঋণ বৃদ্ধি করা সম্ভব হবে না জানি। তবে কঠোর অবস্থান নিলে তা অনেকাংশে দূরীভূত করা সম্ভব। দ্বিতীয় প্রশ্ন হচ্ছে, যারা ইতিমধ্যে দুই নম্বরি করে শত শত, হাজার হাজার কোটি টাকা বানিয়েছে, তাদেরকে বিচারের আওতায় আনা। তৃতীয়ত, এই টাকার কিছু অংশ দেশে আছে, বিরাট অংশ দেশের বাইরে আছে। এই টাকার ‘ফয়সালা’ কী? দেশের ভেতরের টাকা চিহ্নিত করে তা বাজেয়াপ্ত করে সরকারের কোষাগারে জমা করা যায়। এটা একটা লম্বা প্রক্রিয়া। তবে শুরু করতে বাধা কোথায়? পরের প্রশ্নটি আরো জটিল। দেশের বাইরে যে টাকা গেছে, তা উদ্ধারের ব্যবস্থা কী? এখানে আরো ঘোরতর প্রশ্ন। বেআইনি টাকা বিভিন্ন উন্নত দেশে রাখা হলো কীভাবে? সব দেশেই এখন ‘মানি লন্ডারিং প্রিভেনশন আইন’ আছে। ব্যাংকে ব্যাংকে অবৈধ টাকা রাখা কঠিন ব্যাপার। দেখা গেছে, এতত্সত্ত্বেও অনেক দেশ অবৈধ টাকা সাদরে গ্রহণ করে। এই টাকার মালিকদের নাগরিকত্ব দেয়, স্থায়ীভাবে বসবাসের অনুমতি দেয়। আমি মনে করি, এই ব্যবস্থা চালু থাকলে বাংলাদেশের ভেতরে অবৈধভাবে টাকা বানানোর চেষ্টা বন্ধ করা কঠিন। অবৈধভাবে টাকা বানানোর কাজ বন্ধ করতে হলে দেশের ভেতর যেমন তা ব্যাংকে রাখাকে কঠিন করতে হবে, তেমনি কঠিন করতে হবে বিদেশেও। এবং তা সম্ভব সকল দেশ অক্ষরে অক্ষরে ‘মানি লন্ডারিং প্রিভেনশন আইন’ কার্যকর করলে। এবার প্রশ্ন, যে টাকা বিদেশে গেছে তা ফেরত আনার ব্যবস্থা কী? স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় তা দুরূহ কাজ, প্রায় অসম্ভবই বটে। যেটা হতে পারে, তা হচ্ছে ঐসব টাকা ‘জাতীয়করণ’ করা। তা করে জাতিসংঘকে খবর দেওয়া যে, বাংলাদেশিদের অবৈধভাবে রাখা টাকা সরকার জাতীয়করণ করেছে। তা ফেরত আনার ব্যবস্থা করা হোক। জাতিসংঘের দুর্নীতিবিরোধী ‘কনভেনশন’ বা অবস্থান আছে। তারা এই কাজে সাহায্য করতে বাধ্য। এভাবে ফিলিপাইনের মার্কোসের টাকাসহ অনেক স্বৈরশাসকের টাকা দেশে ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থা জাতিসংঘ অতীতে করেছে। আমরা এই পথ ধরতে পারি। সবকিছুই সম্ভব, কিন্তু বাধা একটি। রাজনীতি ও ব্যবসা এক হয়ে গেছে। যারা রাজনীতিবিদ, রাজনৈতিক কর্মী তারাই ব্যবসায়ী। যারা ব্যবসায়ী তারাই রাজনীবিদ, রাজনৈতিক কর্মী।  দুর্নীতির টাকা ব্যবসায়ে ঢুকে যাচ্ছে। এই বৃত্ত ভাঙা কি সম্ভব? উগ্র বাজার অর্থনীতিতে কি তা সম্ভব? সম্ভব হতে পারে যদি দেশে ব্যবসায়-বাণিজ্য সমপরিবেশে, মেধা, শ্রম, দক্ষতা ও প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে পরিচালিত হয়। বর্তমানে তা হচ্ছে না। যদি হতো, তাহলে এই অবস্থা হতো না।  মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এই জায়গাটিকেই আঘাত করেছেন। আঘাত করে তিনি ‘বাঘের’ পিঠে চড়েছেন। তার এগোনো ছাড়া বিকল্প নেই।

n লেখক : অর্থনীতিবিদ ও সাবেক শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যাল